ধানের খোলপঁচা রোগ ও তার প্রতিকার | খোলপঁচা রোগ

ধানের খোলপঁচা রোগ পরিচিতিঃ

বাংলাদেশে ধানের প্রধান প্রধান রোগগুলোর মধ্যে ধানের খোলপঁচা রোগ (Sheath rot) একটি অন্যতম ক্ষতিকারক রোগ। সাধারণত ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, কৃমি ইত্যাদি জীবাণুুর আক্রমণে ফসলের রোগ হয়ে থাকে। এসব জীবাণুর কিছু বীজবাহিত আবার কিছু জীবাণু বীজ থেকে গাছ আবার গাছ থেকে পুনরায় বীজে ছড়াতে পারে। ধানের খোলপঁচা রোগের জীবাণু এমন এক প্রকার ছত্রাক যা ধানের  বীজ থেকে গাছ আবার গাছ থেকে পুনরায় বীজে ছড়াতে সক্ষম।ধানের খোলপঁচা রোগটি বাংলাদেশের প্রায় সকল অঞ্চলেই দেখা যায়। এবং খোলপঁচা রোগ ধানের ফলন ও গুণগতমান কমিয়ে দেয়। যার ফলে কৃষক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তাই এই ক্ষতি থেকে পুষিয়ে উঠতে হলে ধানের খোলপঁচা রোগ পরিচিতি ও দমন পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হবে। যা নিম্নে আলোচনা করা হলঃ

ধানের খোলপঁচা রোগ ও তার প্রতিকার,ধানের খোলপঁচা রোগের জীবাণু এমন এক প্রকার ছত্রাক যা ধানের  বীজ থেকে গাছ আবার গাছ থেকে পুনরায় বীজে ছড়াতে সক্ষম।
ধানের খোলপঁচা রোগ


রোগের নাম ও জীবাণুঃ 

 ধানের খোলপঁচা রোগ (Sheath rot)। Sarocladium oryzae  নামক ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে। এবং এটা বীজবাহিত রোগ।

ধানের খোলপঁচা রোগের ক্ষতির ধরণঃ

★ ধানের খোলপঁচা রোগটি সাধারনত ধানের থোড় অবস্থা থেকে শুরু হয়। এবং কোন অবস্থাতেই ধানের পাতায় হয় না। ধানের থোড় আসার সময় এই রোগের আক্রমণ দেখা যায়। 

★ ধানের খোলপঁচা রোগটি যে কোন খোলে হতে পারে। তবে শুধুমাত্র ডিগ পাতার খোল আক্রান্ত হলেই ধানের ক্ষতি হয়ে থাকে। 

★ প্রাথমিক অবস্থায় ক্ষেতে দাঁড়ানো পানির উচচতায় ধানের কাণ্ডে দাগ পড়ে। অতপড় গাছের শীর্ষ পাতার খোল অর্থাৎ যে খোলে ধানের শীষ থাকে তার  উপর গোলাকার বা অনিয়ত দাগ দেখা যায়।

★ দাগের কেন্দ্র ধূসর ও কিনারা বাদামী রং বা ধূসর বাদামী হয়। দাগগুলো আকারে ০.৫-১.৫ সেমি লম্বা হয়।

★ দাগগুলো ধীরে ধীরে বড় হয়ে একত্রিত হয়।এবং পরস্পর মিশে সমস্ত খোলে ছড়িয়ে পড়ে।

★ ছত্রাক কান্ডের ভেতরে প্রবেশ করে কান্ডের থোড়ের মুখ বা শীষ পঁচে যায় এবং গুড়া ছত্রাংশ খোলের ভিতর প্রচুর দেখা যায়। 

★ আক্রমণ বেশি হলে শীষ সম্পূর্ণ বের হতে পারে না। শীষ পেঁচিয়ে বা আংশিক বের হয়। শীষে খুব কম সংখ্যক দানা পুষ্ট হয়।এবং ধান কালো ও চিটে হয়ে যায়।

★ অনেক সময় খোল পচা রোগে আক্রান্ত গাছে মাজরা পোকা আক্রমণের ক্ষত দেখা যায়। এ রোগ অন্য খোলেও হতে পারে তবে পাতায় হয় না।  

ধানের খোলপঁচা রোগের বিস্তার

1) ধানের খোলপঁচা রোগ ছত্রাকের মাধ্যমে জীবাণু ধানের  বীজ থেকে গাছ আবার গাছ থেকে পুনরায় বীজে ছড়াতে সক্ষম।

2) প্রধানত আক্রান্ত গাছের বীজ থেকেই এ রোগের বিস্তার লাভ করে থাকে। তাছাড়া রোগাক্রান্ত খড় বিকল্প পোষক হিসেবে কাজ করে।

3) মাজরা পোকা আক্রান্ত ক্ষতস্থানের মাধ্যমে এ রোগ ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়।

4) গরম ও স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া এবং বৃষ্টির ঝাপটায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়।

5) খোলপঁচা রোগটি  সব মৌসুমে দেখা যায়। এবং থোড় অবস্থায় ধানের খোলপঁচা রোগটির উপযোগী সময়। 

6) চৈত্র মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়ে ক্রমান্বয়ে জ্যৈষ্ঠ মাস ও আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ধানের খোলপঁচা রোগের আক্রমণ বাড়তে থাকে। এমনকি আষাঢ়ের শেষ-শ্রাবণের শুরুতে কিছুটা কমলেও শ্রাবণের শেষ-ভাদ্রের পুরো মাসটাই তীব্রতর থাকে। তবে আশ্বিন মাসে কিছুটা কমলেও কার্তিক মাসে বেশ তীব্রতর হয়ে অগ্রহায়ণ মাসে কমতে থাকে।

ধানের খোলপঁচা রোগ আক্রমণের আগে করণীয়ঃ

১. রোগ সহনশীল জাত যেমন বিআর১০, বিআর২২, বিআর২৩, ব্রি ধান৩১ ও ব্রি ধান৩২ চাষ করা যেতে পারে।

২. পরিস্কার পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ করতে হবে এবং  এ ডাব্লিউ ডি পদ্ধতিতে সেচ দিতে হবে।

৩. লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষ করে শুকিয়ে নিয়ে নাড়া জমিতেই পুড়িয়ে ফেলা।

৪. সুষম পরিমানে ইউরিয়া, টিএসপি এবং পটাশ সার ব্যবহার করা।

৫. ধানের জাত অনুসারে সঠিক দুরত্বে চারা রোপণ করা (তবে ২৫x২০ সেন্টিমিটার দূরত্বই ভাল)।

৬. আক্রান্ত ক্ষেত থেকে বীজ সংগ্রহ করবেন না


ধানের খোলপঁচা রোগের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনাঃ

১. Tillering পর্যায়ে পটাশ সার প্রয়োগ করা।

২. সুস্থ ও রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে। অর্থাৎ বীজ ধানের জমি খোল পঁচা রোগ মুক্ত হতে হবে।

৩. পূর্ববর্তী ফসলের অবশিষ্টাংশ অর্থাৎ খড়কুটা জমিতে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।

৪. মিউরেট অব পটাশ (এমওপি) সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে এবং ইউরিয়া সার পরিমাণে কম ব্যবহার করতে হবে।

৫. জমির পানি শুকিয়ে পুনরায় সেচ দিতে হবে। এবং বীজ শোধন করতে হবে।


ধানের খোলপঁচা রোগের ভেষজ পদ্ধতিতে দমন পদ্ধতিঃ

১. পেঁপে পাতা দ্বারা দমনঃ

এক কেজি পরিমাণ পেঁপে পাতা পিষে ১০ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম ডিটারজেন্ট পাউডার একসাথে মিশ্রণ করে মিশ্রণটি ছেঁকে ৫ শতক জায়গায় প্রয়োগ করা।


২. জবা ফুলের পাতা দ্বারা দমনঃ

এক কেজি পরিমাণ জবা ফুলের পাতা পিষে ১০ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম ডিটারজেন্ট পাউডার সহ একত্রে মিশ্রণ করে মিশ্রণটি ছেঁকে ৫ শতক জায়গায় প্রয়োগ করা।

ধানের খোলপঁচা রোগের রাসায়নিক পদ্ধতিতে দমনঃ

ধানের খোলপঁচা রোগ দমনের জন্য নিম্নে রাসায়নিক পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলঃ-


বালাইনাশকের নামঃ এমিস্টার টপ।
গ্রুপঃ এজোক্সিস্ট্রোবিন (২০%)+ডাইফেনোকোনাজল (১২.৫%)।
প্রয়োগ মাত্রাঃ ১০০ মিঃলিঃ/বিঘা।
কোম্পানীঃ সিনজেনটা বাংলাদেশ লিঃ।

বালাইনাশকের নামঃ নোইন ৫০ ডব্লিউপি।
গ্রুপঃ কার্বেন্ডাজিম।
প্রয়োগ মাত্রাঃ ১৩৩ গ্রাম/বিঘা।
কোম্পানীঃ ম্যাকডোনাল্ড বাংলাদেশ (প্রাইভেট) লিঃ।

বালাইনাশকের নামঃ ভালকান ৫০ডব্লিউপি৷
গ্রুপঃ কার্বেন্ডাজিম।
প্রয়োগ মাত্রাঃ ১৩৩ গ্রাম/বিঘা।
কোম্পানীঃ এথারটন ইমব্রুস কোম্পানী লিমিটেড।

বালাইনাশকের নামঃ টিল্ট ২৫০ ইসি।
গ্রুপঃ প্রোপিকোনাজল।
প্রয়োগ মাত্রাঃ ১৩৩ মিঃলিঃ/বিঘা।
কোম্পানীঃ সিনজেনটা বাংলাদেশ লিমিটেড।

বালাইনাশকের নামঃ একোনাজল ২৫০ ইসি।
গ্রুপঃ প্রোপিকোনাজল।
প্রয়োগ মাত্রাঃ ১৩৩ মিঃলিঃ/বিঘা।
কোম্পানীঃ ম্যাকডোনাল্ড বাংলাদেশ(প্রাইভেট) লিঃ।

বালাইনাশকের নামঃ করজল ২৫০ ইসি।
গ্রুপঃ প্রোপিকোনাজল।
প্রয়োগ মাত্রাঃ ১৩৩ মিঃলিঃ/বিঘা।
কোম্পানীঃ করবেল কেমিক্যাল ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিঃ।

বালাইনাশকের নামঃ ট্রুপার ৭৫ ডব্লিউপি।
গ্রুপঃ ট্রাইসাইক্লাজোল।
প্রয়োগ মাত্রাঃ ৫৪ গ্রাম/বিঘা।
কোম্পানীঃ অটো ক্রপ কেয়ার লিমিটেড।

বালাইনাশকের নামঃ ডিফা ৭৫ ডব্লিউপি।
গ্রুপঃ ট্রাইসাইক্লাজোল।
প্রয়োগ মাত্রাঃ ৫৪ গ্রাম/বিঘা।
কোম্পানীঃ ইনতেফা।

বালাইনাশকের নামঃ এল সাইক্লাজোল ৭৫ ডব্লিপি।
গ্রুপঃ ট্রাইসাইক্লাজোল।
প্রয়োগ মাত্রাঃ ৫৪ গ্রাম/বিঘা।
কোম্পানীঃ দি লিমিট এগ্রোপ্রোডাক্টস লিমিটেড।

বালাইনাশকের নামঃ ফিলিয়া ৫২৫ এসই।
গ্রুপঃ প্রোপিকোনাজল (১২.৫%)+ ট্রাইসাক্লাজোল (৪০%)।
প্রয়োগ মাত্রাঃ ১৩৩ মিঃলিঃ/বিঘা।
কোম্পানীঃ সিনজেনটা বাংলাদেশ লিমিটেড।

বালাইনাশকের নামঃ প্রাউড ২৫ ইসি।
গ্রুপঃ প্রোপিকোনাজল।
প্রয়োগ মাত্রাঃ ১৩৩ মিঃলিঃ/বিঘা।
কোম্পানীঃ এসিআই ফর্মুলেশনস লিমিটেড।

বালাইনাশকের নামঃ কনটাফ ৫ ইসি।
গ্রুপঃ হেক্সাকোনাজল।
প্রয়োগ মাত্রাঃ ৬৭ মিঃলিঃ/বিঘা।
কোম্পানীঃ অটো ক্রপ কেয়ার লিমিটেড।

বালাইনাশকের নামঃ নাটিভো ৭৫ ডব্লিউপি।
গ্রুপঃ টেবুকোনাজল(৫০%) + ট্রাইফ্লোক্সিস্ট্রোবিন(২৫%)।
প্রয়োগ মাত্রাঃ ৪০ গ্রাম/বিঘা।
কোম্পানীঃ বায়ার ক্রপসায়েন্স লিমিটেড।


নোটঃ-মাজরা পোকার ক্ষতস্থানের মাধ্যমে খোল পচা রোগের ছত্রাক বিস্তার লাভ করে তাই এ পোকা দমনের জন্য ডায়াজিনন ৬০ ইসি/কার্বোফুরান ৫ জি কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।


যোগাযোগ

কৃষি বিষয়ক যে কোন সমস্যার সমাধান ও ফসলের রােগবালাই এবং পােকামাকড় দমনে সঠিক পরামর্শ দিতে আপনার পাশে রয়েছে ekrishi24.com অথবা নিকটস্থ “কৃষক তথ্য ও পরামর্শ কেন্দ্র (ফিয়াক)” অথবা “উপ সহকারী কৃষি অফিসার” এর সাথে যোগাযোগ করুন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url