নারকেল গাছের ডাব/ফল ঝরে পড়া প্রতিরোধ ব্যবস্হাপনা পদ্ধতি
নারকেল গাছের ডাব/ফল ঝরে পড়া প্রতিরোধ ব্যবস্হাপনা পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা
দেশে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে নারকেলের চাষ বেশি না হলেও প্রায় সবার বাড়িতে দু’একটি নারকেল গাছ আছে। এসব গাছে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়।এরমধ্যে কচি অবস্থায় নারকেল ঝরে পড়া একটি প্রধান সমস্যা। সাধারণত নারকেল গাছে ফুল আসার পর থেকে ডাব হওয়া পর্যন্ত নারকেল ঝরে পড়ার কয়েকটি কারণ হতে পারে। যেমন- ফুলে পরাগ সংযোগ না হওয়া, কচি ফলগুলোতে পোকার আক্রমণ হলে, মাটিতে সারের অভাব হলে, নারকেলের ভেতরের শাঁস অংশ গঠনে ব্যাঘাত ঘটলে, মাটিতে পানির অভাবসহ ইত্যাদি।
উঁচু জাতের নারকেল স্বভাবত স্ব-পরাগ যুক্ত না হওয়ার জন্য সেটা অন্য নারকেল গাছের রেণুর উপর নির্ভরশীল। প্রতিকূল পরিবেশ যেমন- একসঙ্গে কয়েকদিন হওয়া বৃষ্টিতে অন্য গাছ থেকে পরাগ রেণু স্ত্রী ফুলে পড়ে না বা পরাগযোগ হওয়ার আগে বৃষ্টির পানিতে পরাগারেণু ভেসে যায়। সেজন্য নারকেলের একটি বা দুটি গাছ রোপণ না করে এক সঙ্গে ১০-১৫টি গাছ রোপণ করতে হবে। ছোট জাতের নারকেল স্ব-পরাগ যুক্ত হওয়ার জন্য সমস্যা থাকে না। এ জন্য নারিকেলের ফলঝরা সমস্যা সমাধানে প্রত্যেকটি বিষয়ের দিকেই নজর দেয়া উচিত।
|
| নারকেল গাছের ডাব/ফল ঝরে পড়া |
কি কারণে ডাব ঝরে?
১.গাছের বয়স
নারিকেল গাছের বয়স পাঁচ-ছয় বছর হলেই তাতে ফল ধরে। তবে ছোট অবস্থাতেই ফল ঝরে যায়। কম বয়সী গাছে ফুল এলেও তা থেকে ফল না নিয়ে সাত-আট বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত।
২.উপযোগী জাত
কোন এলাকায় কোন জাতের নারিকেল ভালো হতে পারে তার উপযোগিতা যাচাই করেই নারিকেল গাছ রোপণ করা উচিত
৩.মাটির ধরন
উর্বর মাটি বা কম চুনযুক্ত (১০-১৪ শতাংশ)মাটি নারিকেল চাষেবেশি উপযোগী।
৪.পোকার আক্রমণ
রোগ বা পোকার আক্রমণ হলে ওষুধ প্রয়োগ করে এর নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নারকেলের ফুল বা ফল খাওয়া পোকায় আক্রমণ করলে ২ মিলি রগর এক লিটার পানিতে মিশিয়ে ফুলের উপর ভালভাবে স্প্রে করতে হবে। গাছের কুঁড়ি বা পচা রোগের জন্য ১ শতাংশ শক্তিযুক্ত বোর্দো মিশ্রণ গাছের অগ্রভাগে বিশেষ করে পাতার গোড়ায় ভাল করে প্রয়োগ করতে হবে।
৫.পরাগায়নের প্রভাব
নারিকেল ফুলে পরাগায়ন সংঘটিত হয় পোকা বিশেষ করে মৌমাছি অথবা বাতাসের মাধ্যমে। এজন্য একই এলাকায় একাধিক নারিকেল গাছ থাকা দরকার,এতে পরাগায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ফুল থাকে।
শুকনা মৌসুমে অনেক দিন পর হঠাৎ বৃষ্টি হলে এবং এ বর্ষণ ৫-৭ দিন ধরে চলতে থাকলে ফুলে ফল ধরার জন্য পরাগায়ন সমস্যা হয়। এ সমস্যা দুইভাবে হতে পারে
প্রথমত :
পুরুষ ফুলের পরাগ রেণু ধুয়ে পড়ে যাওয়া এবং স্ত্রী ফুলের আগায় পরাগ রেণু পড়ে তা পরাগায়ন সুবিধার জন্য যে মধু বা নেকটার থাকে তা ধুয়ে গেলে পরাগায়ন ক্ষমতা হারায়।
দ্বিতীয়ত :
দীর্ঘ সময় অনাবৃষ্টি ও শুকনা হাওয়ার পর হঠাৎ বৃষ্টিপাতের ফলে তাপমাত্রার অনেক ব্যবধান (দীর্ঘ কাল গরমের পর হঠাৎ ঠাণ্ডা পড়া) সৃষ্টি হয়, যা ফুল থেকে ফল ধরতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।ফুল ফোটার পর বেশি সময় ধরে শুকনা ঝড়ো বাতাসের প্রভাবেও নারিকেল গাছের পরাগ রেণু ঝরে পড়ে, মৌমাছির তৎপরতা এ ধরনের প্রতিকূল আবহাওয়ায় প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। যা পরাগায়নে প্রতিকূল প্রভাব পড়ে।
মৌমাছি যাতে নারিকেল গাছের এলাকায় ঘোরাফেরা করে সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হয়। নারিকেলের ফুল ফোটার আগে অপ্রয়োজনে কোনো বালাইনাশক স্প্রে করা ঠিক নয়।
৬) নিম্ন মানের নারিকেল গাছ
অনেক সময় দেখা যায় নারিকেল গাছের লাগানো জাতটা নিম্ন মানের, স্ত্রী-পুরুষ উভয় ফুল-ফল ধরার ক্ষমতা কম থাকে, যা জাতগত (Genetical) কারণে হয়ে থাকে।
ফুল-ফল ধরাকালে নারিকেল গাছে রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণের প্রভাব গাছে ফুল-ফল ঝরার অন্যতম কারণ। এজন্য নারিকেল গাছ যেন সব সময় রোগবালাইমুক্ত থাকে সে ব্যবস্থা অবশ্যই নিতে হবে।
৭) মাটির রসের পরিমাণ
সাধারণত মাটিতে সারের অভাব হলে কচি অবস্থায় নারকেল বেশি করে ঝরে পড়ে। নারিকেল গাছের গোড়ায় যদি রস বেশি বা সব সময় স্যাঁতস্যাঁতে থাকে অথবা একেবারে শুকনো থাকে তাহলে গাছের ভেতরের অবস্থা ও ক্রমবর্ধিষ্ণু ফলের কুঁড়ির মধ্যকার আর্দ্রতার অসাম্যতা দেখা দেয়। এতে ফলের কুঁড়ির বোঁটা অতিরিক্ত নরম বা শুকনো হয়ে যায় এবং ফল ঝরে পড়ে।
৮) আবহাওয়ায় কারণে
আবহাওয়ায় আর্দ্রতার কম-বেশিও ফল ঝরার কারণ হতে পারে। এ জন্য নারিকেল গাছের গোড়ার মাটিতে যেন সব সময় জো অবস্থা থাকে সে দিকে লক্ষ রাখতে হয়। গ্রীষ্মে অতিরিক্ত গরমের সময় রাতে ও শীতে অতিরিক্ত ঠাণ্ডার সময় দিনে নারিকেলের পাতায় শুধু পানি স্প্রে করে গাছের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ধরে রাখতে সাহায্য করলে ওই সময়ের অস্বাভাবিক অবস্থায় ফল ঝরে পড়ে না বা ফল নষ্ট হয় না।
৯) সারের অভাব
সাধারণত মাটিতে সারের অভাব হলে কচি অবস্থায় নারকেল বেশি করে ঝরে পড়ে। নারকেল গাছে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশ সারের সঙ্গে সোহাগা প্রয়োগের বিশেষ প্রয়োজন।
ক) পটাশ সারের অভাব হলে নারকেলের শাঁস গঠনে ব্যাঘাত হয় ও নারকেল ঝরে পড়ে।
খ) গোবর সার বা পচন সারের সঙ্গে অনুমোদিত রাসায়নিক সার মিশিয়ে দু'ভাগ করে এক অংশ বর্ষার আগে (চৈত্র-বৈশাখ) এবং অন্য অংশ বর্ষার পরে (অশ্বিন-কার্তিক) মাসে প্রয়োগ করতে হবে।
গ) নারিকেল গাছের গোড়ায় মাটিতে পানি ও খাবার কম থাকলে কচি ডাব ঝরে পড়ে।
ঘ) পটাশিয়ামের অভাবে কচি ডাব বেশি ঝরে। এক্ষেত্রে মাটিতে পটাশিয়াম ও নাইট্রোজেন জাতীয় সার ব্যবহার করতে হবে।
ঙ) নারিকেল গাছের গোড়ায় চারদিকে ১.৮ মিটার দূরে বৃত্তাকার গর্ত করে ইউরিয়া ৪ কেজি, এমওপি ৬ কেজি, টিএসপি ১ কেজি এবং সামান্য লবণ দিতে হবে। খেয়াল রাখবেন লবণাক্ত এলাকায় লবণ দেয়া উচিৎ না।
১০) অতিরিক্ত ফল ধারণ
অনেক সময় গাছে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ফল ধরে এবং প্রতিটি ফল পরিমিত পরিমাণ পুষ্টির অভাবে সঠিকভাবে বাড়তে না পারায় বেশির ভাগই ঝরে পড়ে। এ জন্য দু’টি ছড়ি বের হওয়ার মধ্যে সময়ের পার্থক্য কম হলে ছড়িগুলো থেকে ফলসংখ্যা ছাঁটাই করে ফেলা দরকার। এতে বাকিগুলো ঠিকভাবে বাড়তে পারে ও ফলঝরা কমে।
১১) ত্রুটিপূর্ণ ছাঁটাই:
নারিকেল গাছের সবুজ পাতা ছাঁটাই করা কোনোক্রমেই উচিত নয়। যেসব পাতা শুকিয়ে যায় সেগুলোর গাছের সাথে লেগে থাকা মোটা বোঁটাটি না শুকানো পর্যন্ত কাটা উচিত নয়। সবুজপাতা কাটলে গাছে খাদ্য তৈরি কমে যায়। এতে ফলঝরে পড়তে পারে।
১২) জৈব বা অজৈব সার প্রয়োগ ও পরিমাণ :
খরার সময় জমিতে পানির পরিমাণ কমে গেলে বা খরার পর ভারী বৃষ্টিপাত হলে গাছে পানির পরিমাণ বেড়ে গেলে ছোট ছোট নারকেলগুলো ঝরে পড়ে। সেজন্য খরার সময় নারকেল গাছের গোড়ায় ১৫-২০ দিন পর পানি দেয়ার প্রয়োজন। জমিতে পানির অভাব হলে বা প্রতিকূল অবস্থায় ফল এবং ডাটার গোড়ায় এবসাইজিক অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং ফল ঝরে পড়ে। এমন অবস্থায় ৬০ পিপিএম শক্তির ২-৪-ডি মিশ্রণ ফুলের ডাটায় ৭ দিন পর পর ৪ বার প্রয়োগ করলে ঝরে পড়া বন্ধ হয়। প্লেনোফিক্স জাতীয় হরমোনের ১০ পিপিএম মিশ্রণ নারকেলের ফুলে এবং পরে ২০ পিপিএম নারকেলের ডাটায় প্রয়োগ করলেও নারকেল ঝরে পড়া বন্ধ হয়। সুস্থ্য এবং রোগ, পোকার আক্রমণ না থাকা গাছের নারকেল হরমোনের জন্য সাধারণত ঝরে পড়ে।
বিশেষভাবে পড়ুন
সমস্যা:
আমার নারিকেল গাছে প্রতেক বছরে নারিকেল আসে। কিন্তু তা বড় হবার আগেই ঝরে পরে যায়। কোন কোন বছর এক দুইটি টিকে। আবার কোন কোন বছর সব গুলি ঝরে পরে যায়। নারিকেল যাতে ঝরে না পরে তার জন্য করনিয় কি?
সমাধান:
আপনি বর্ষার আগে ও পরে গাছ প্রতি ১০০ গ্রাম এমওপি সার ও ২০ গ্রাম বোরন সার প্রয়োগ করবেন। সেক্ষেত্রে নারকেল গাছ হতে দেড়হাত দূরে গোলাকার ৬ ইঞ্চি গভীর নালা করে সার প্রয়োগ করার পর মাটি দিয়ে চেপে দিতে হবে এবং হালকা সেচ দিয়ে দিবেন।
সমস্যা:
নারিকেল গাছের ফল কুঁড়ি অবস্থায় ঝরে যায়। বয়স ১৫ বছর। করণীয় কি?
সমাধান:
ফল ঝড়ে পড়ার জন্য ওকিজোম বা সি গোল্ড ১.৫ মিলি/ লিটার পানিতে মিশিয়ে ফুল আসার সাথে সাথে ১০ দিন পর পর ২/৩ বার স্প্রে করুন।
সমস্যা:
গাছে নারকেল ফেটে পানি পরে যায়। গাছের বয়স ৫ বছর। সমস্যা ১ বছর যাবত।
সমাধান:
১. গাছ প্রতি ২০০ গ্রাম পটাশ, ১০০ গ্রাম বোরাক্স বা বোরিক পাউডার দিতে হবে।
২. বাজারে প্লানোফিক্স হরমোন পাওয়া গেলে তা দেওয়া যেতে পারে।
