ধানের খোলপোড়া রোগ পরিচিতি ও দমন ব্যবস্থাপনা | খোলপোড়া রোগ
ধানের খোলপোড়া রোগ পরিচিতি
ekrishi24.com: বাংলাদেশের ধানের প্রধান
রোগগুলোর মধ্যে ধানের খোলপোড়া রোগ (Sheath blight) অন্যতম।ধানের খোলপোড়া রোগটি
ছত্রাকজনিত রোগ। ধান গাছের কুশি গজানোর সময় হতেই
ধানের খোলপোড়া রোগটির আক্রমণ শুরু হয়। বাংলাদেশের প্রায় সকল অঞ্চলেই
রোগটি দেখা যায়। এবং আমাদের দেশে ধানের খোলপোড়া রোগটি আউশ ও আমন মৌসুমের
ধানের বেশি ক্ষতি করে। ধানের খোলপোড়া রোগটি ফলন শতকতা ৩০ ভাগ পর্যন্ত
কমিয়ে দেয়। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা এবং সচেতন চাষাবাদের মাধ্যমে
ধানের খোলপোড়া রোগ থেকে রেহাই পাওয়া যায়।
|
| ধানের খোলপোড়া রোগ পরিচিতি |
রোগের নামঃ খোলপোড়া রোগ (Sheath blight)।
রোগের জীবাণুঃ Rhizoctonia solani নামক ছত্রাক জীবাণু।
খোলপোড়া রোগের ক্ষতির লক্ষণঃ
১) কুশি গজানোর সময় হতে ধান পাকা পর্যন্ত এ রোগ দেখা যায়।
২) পানির সমতলের একটু উপরে প্রথমে ছোট গোলকার বা লম্বাটে ধরনের ধূসর রঙের জলছাপের মত পানি ভেজা দাগ পড়ে খোলের উপরে।
৩) পড়ে আস্তে আস্তে তা বড় হয়ে উপরের দিকে সমস্ত খোল ও পরে পাতায় ছড়িয়ে পড়ে।
৪) ডিম্বাকৃতি বা বর্তুলাকার এ সব দাগ প্রায় ১ সেন্টিমিটার লম্বা হয় এবং বড় হয়ে দাগগুলো ২-৩ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বড় হতে পারে।
৫) দাগের কেন্দ্রস্থল খয়েরি রঙের ও কিনারা গাঢ় বাদামি হয়।
৬) এ অবস্থায় দাগগুলো বড় হয়ে গোখরা সাপের চামড়ার মত দেখায়।
৭) তীব্র আক্রমণে গাছ পোড়াভাব ধারণ করে ও মাঝে মাঝে বসে যায়।
৮) উষ্য ও আর্দ্র আবহাওয়ায় রোগের বিস্তার বেশি হয়।
৯) ইউরিয়া সার বেশি দিলে, আবহাওয়া গরম ও সেঁত সেঁতে হলে খোলপোড়া রোগ ছাড়ায়।
১০) আক্রান্ত জমি মাঝে মাঝে পুড়ে বসে যাওয়ার মত মনে হয় । রোগের প্রকোপ বেশি হলে ধান চিটা হয়ে যায়।
১১) ফুল হওয়া থেকে ধান পাকা পর্যন্ত রোগের লক্ষণ স্পষ্ট দেখা যায়। আক্রান্ত
গাছের কুশির শীষ বের হতে পারে না, শীষ অর্ধেক বের হলেও ধান কালো ও চিটা হয়।
খোলপোড়া রোগ বিস্তারের উপযুক্ত পরিবেশঃ
A) ধানের খোলপোড়া রোগ বিস্তারের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ যেমন:- মেঘলা আকাশ,
গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি এবং গুমোট আবহাওয়া যদি একাধারে ২-৫ দিন বিরাজ করে এবং সে
সঙ্গে তাপমাত্রা ২৫-৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা থাকলে খোলপোড়া রোগ ছড়িয়ে
পড়ে।
B) অতিরিক্ত নাইট্রোজেন সার ব্যবহার এবং ৮৫-১০০% আপেক্ষিক আর্দ্রতা সহায়ক। বিশেষ
করে বর্ষাকালে এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। পত্রপল্লব খুব ঘন
থাকলে একে অপরের সংস্পর্শে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে।
C) ধান গাছে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ, শ্রাবণ-ভাদ্র, কার্তিক-অগ্রহায়ণ এই তিনটি সময়ে
খোলপোড়া রোগের আক্রমণ বেশ তীব্রতর হয়।
D) ধানের খোলপোড়া রোগের ছত্রাক মাটিতে স্ক্লেরোশিয়াম (sclerotium) আকারে
কয়েক বছর পর্যন্ত জীবিত থাকতে পারে। জমি পানির নিচে চলে গেলে এ জীবাণুগুলো ভাসতে
থাকে। যখনই ধানগাছের সংস্পর্শে আসে তখনই ছত্রাক পাতার খোলে প্রবেশ করে নতুন করে
রোগাক্রমণের সূচনা করে।
খোলপোড়া রোগের দমন ব্যবস্থাপনা
★ জমি শেষ চাষ ও মই দেয়ার পর আইলের কিনারা বরাবর ভাসমান ময়লা আবর্জনা সুতি কাপড়
দিয়ে সংগ্রহ করে মাটিতে পুঁতে ফেলা।
★ রোগ সহনশীল জাত যেমন বিআর-১০, বিআর-২২, বিআর-২৩, ব্রি ধান-৩১, ব্রি ধান-৩২ ব্রি ধান-৩৮, ব্রি ধান-৩৯,ব্রি ধান-৪০, ব্রি ধান-৪১ চাষ করা যেতে পারে।
★ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ করা।
★ লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষ করে শুকিয়ে নিয়ে নাড়া জমিতেই পুড়িয়ে ফেলা।
★ সুষমভাবে ইউরিয়া, টিএসপি এবং পটাশ সার ব্যবহার করা।
★ ইউরিয়া সার ২-৩ কিস্তিতে প্রয়োগ করাই ভালো।
★ ধানের জাত অনুসারে সঠিক দূরত্বে চারা রোপণ করা (তবে ২৫x২০ সেন্টিমিটার দূরত্বই ভাল)।
★ রোগ দেখার পর ১৫ দিন অন্তর বিঘা প্রতি ৫ কেজি পটাশ দুই কিস্তিতে দিলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
★ রোগ দেখা দিলে জমির পানি শুকিয়ে ৭-১০ দিন রাখার পর আবার সেচ দেয়া।
খোলপোড়া রোগের ভেষজ পদ্ধতিতে দমন
১. পেঁপে পাতা দ্বারা দমনঃ
এক কেজি পরিমাণ পেঁপে পাতা পিষে ১০ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম ডিটারজেন্ট পাউডার একসাথে মিশ্রণ করে মিশ্রণটি ছেঁকে ৫ শতক জায়গায় প্রয়োগ করা।২. জবা ফুলের পাতা দ্বারা দমনঃ
এক কেজি পরিমাণ জবা ফুলের পাতা পিষে ১০ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম ডিটারজেন্ট পাউডার সহ একত্রে মিশ্রণ করে মিশ্রণটি ছেঁকে ৫ শতক জায়গায় প্রয়োগ করা।খোলপোড়া রোগের রাসায়নিক দমন
সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ধানের খোলপোড়া রোগের নিয়ন্ত্রণের জন্য সর্বদা প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিন। ধানের খোলপোড়া রোগের রাসায়নিক দমন নিছে দেওয়া হলঃ-
বালাইনাশকের নামঃ এমিস্টার টপ।
গ্রুপঃ এজোক্সিস্ট্রোবিন(২০%)+ডাইফেনোকোনাজল (১২.৫%)।
প্রয়োগ মাত্রাঃ ১০০ মিঃলিঃ/বিঘা।
কোম্পানীঃ সিনজেনটা বাংলাদেশ লিঃ।
বালাইনাশকের নামঃ নাটিভো ৭৫ ডব্লিউপি।
গ্রুপঃ টেবুকোনাজল (৫০%) + ট্রাইফ্লোক্সিস্ট্রোবিন (২৫%)।
প্রয়োগ মাত্রাঃ ২৭ গ্রাম/বিঘা।
কোম্পানীঃ বায়ার ক্রপসায়েন্স লিমিটেড।
বালাইনাশকের নামঃ ফলিকুর ইডব্লিউ ২৫০।
গ্রুপঃ টেবুকোনাজল।
প্রয়োগ মাত্রাঃ ৬৭ মিঃলিঃ/বিঘা।
কোম্পানীঃ বায়ার ক্রপসায়েন্স লিমিটেড।
বালাইনাশকের নামঃ ফিলিয়া ৫২৫ এসই।
গ্রুপঃ প্রোপিকোনাজল (১২.৫%) + ট্রাইসাক্লাজোল (৪০%)।
প্রয়োগ মাত্রাঃ ১৩৩ মিঃলিঃ/বিঘা।
কোম্পানীঃ সিনজেনটা বাংলাদেশ লিঃ।
বালাইনাশকের নামঃ কনটাফ ৫ ইসি।
গ্রুপঃ হেক্সাকোনাজল।
প্রয়োগ মাত্রাঃ ৬৭ মিঃলিঃ/বিঘা।
কোম্পানীঃ অটো ক্রপ কেয়ার লিমিটেড।
বালাইনাশকের নামঃ কন্ট্রোল ৫ ইসি।
গ্রুপঃ হেক্সাকোনাজল।
প্রয়োগ মাত্রাঃ ৬৭ মিঃলিঃ/বিঘা।
কোম্পানীঃ সার্ক বাংলাদেশ।
বালাইনাশকের নামঃ ক্রিজোল ৫ ইসি।
গ্রুপঃ হেক্সাকোনাজল।
প্রয়োগ মাত্রাঃ ৬৭ মিঃলিঃ/বিঘা।
কোম্পানীঃ ম্যাকডোনাল্ড ক্রপ কেয়ার লিমিটেড।
বালাইনাশকের নামঃ এক্সট্রাকেয়ার ৩০০ ইসি।
গ্রুপঃ ডাইফেনোকোনাজল (১৫%) + প্রোপিকোনাজল(১৫%)।
প্রয়োগ মাত্রাঃ ১৬ মিঃলিঃ/বিঘা
কোম্পানীঃ হেকেম (বাংলাদেশ) লিমিটেড।
বালাইনাশকের নামঃ কম্বি-২ ৩০ ইসি।
গ্রুপঃ ডাইফেনোকোনাজল (১৫%) + প্রোপিকোনাজল (১৫%)।
প্রয়োগ মাত্রাঃ ১৬ মিঃলিঃ/বিঘা।
কোম্পানীঃ ন্যাশনাল এগ্রিকেয়ার ইমপোর্ট এন্ড এক্সপোর্ট লিঃ।
বালাইনাশকের নামঃ ক্রপসেপ ৩০০ ইসি।
গ্রুপঃ ডাইফেনোকোনাজল (১৫%) + প্রোপিকোনাজল (১৫%)।
প্রয়োগ মাত্রাঃ ১৬ মিঃলিঃ/বিঘা।
কোম্পানীঃ মিমপেক্স এগ্রোকেমিক্যালস লিমিটে।
বালাইনাশকের নামঃ টিল্ট ২৫০ ইসি।
গ্রুপঃ প্রোপিকোনাজল।
প্রয়োগ মাত্রাঃ ১৩৩ মিঃলিঃ/বিঘা।
কোম্পানীঃ সিনজেনটা বাংলাদেশ লিমিটেড।
বালাইনাশকের নামঃ একোনাজল ২৫০ ইসি।
গ্রুপঃ প্রোপিকোনাজল।
প্রয়োগ মাত্রাঃ ১৩৩ মিঃলিঃ/বিঘা।
কোম্পানীঃ ম্যাকডোনাল্ড বাংলাদেশ (প্রাইভেট)।
বালাইনাশকের নামঃ করজল ২৫০ ইসি।
গ্রুপঃ প্রোপিকোনাজল।
প্রয়োগ মাত্রাঃ ১৩৩ মিঃলিঃ/বিঘা।
কোম্পানীঃ করবেল কেমিক্যাল ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিঃ।
বালাইনাশকের নামঃ নোইন ৫০ডব্লিউপি।
গ্রুপঃ কার্বেন্ডাজিম।
প্রয়োগ মাত্রাঃ ১৩৩ গ্রাম/বিঘা।
কোম্পানীঃ ম্যাকডোনাল্ড বাংলাদেশ(প্রাইভেট)লিঃ।
বালাইনাশকের নামঃ ভালকান ৫০ ডব্লিউপি।
গ্রুপঃ কার্বেন্ডাজিম।
প্রয়োগ মাত্রাঃ ১৩৩ গ্রাম/বিঘা।
কোম্পানীঃ এথারটন ইমব্রুস কোম্পানী লিমিটেড।
