ধানের বীজতলা তৈরী,বীজ বপন ও চারা রোপণ পদ্ধতি | ধানের বীজতলা
ধানের আদর্শ বীজতলা তৈরি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা
দীর্ঘ, মধ্যম ও স্বল্প জীবনকালের জাতের জন্য আলাদা আলাদা স্থান ও একেক সময়ে একেক রকমের বীজতলায় বপন করতে হবে। মধ্যম মাত্রার উর্বর মাটিতে বীজতলার জন্য কোনো সার প্রয়োগের দরকার হয় না। কিন্তু নিম্ন, অতি নিম্ন অথবা অনুর্বর মাটির ক্ষেত্রে গোবর বা খামারজাত সার প্রতি শতকে ২ মণ হিসাবে প্রয়োগ করতে হবে।তাই চাষিদের জন্য ধানের আদর্শ বীজতলা তৈরি ও বপনের সময় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা।
|
|
| ধানের আদর্শ বীজতলা তৈরি | ধানের বীজতলা |
বীজতলার আদর্শ জমি নির্বাচন
🌾 চারিদিক খোলা, রোদ পড়ে এমন উর্বর ও সেচ সুবিধাযুক্ত জমিতে বীজতলার জন্য নির্বাচন করতে হবে।
আরও জানুন
ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক
সাইপারমেথ্রিন ক্লোরোপাইরিফস গ্রুপের কীটনাশক
🌾 ছায়াযুক্ত যায়গায় বীজতলা হলে ধানের চারা লম্বা ও লিকলিকে হয়ে যায় এবং চারা রোগাক্রান্ত হতে পারে।
🌾চাষের আগে প্রতি বর্গমিটার (প্রায় ১ ফুট x ৩.৫ ফুট) জায়গার জন্য ২-৩ কেজি জৈব সার দিয়ে ভালোভাবে জমি তৈরি করতে হবে।
🌾জমিতে ভালোমত পানি ও চাষ-মই দিয়ে, জমি থকথকে কাদাময় তৈরী করে এক মিটার চওড়া এবং জমির দৈর্ঘ্য অনুসারে লম্বা করে ভেজা বীজতলা তৈরি করতে হবে।
🌾বীজতলার প্রতি দুই বেডের মাঝে ২৫- ৩০ সেমি নালা/ড্রেন রেখে, সেখান থেকে মাটি উঠিয়ে বীজতলা একটু উঁচু ও সমতল করে তৈরী করতে হবে।এতে করে চারা গজানোর পর প্রয়োজনে বীজতলার মাঝখান দিয়ে হাঁটাচলা করা, চারায় পানি সেচ ও অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা করা সহজতর হয়।
🌾প্রতি বর্গমিটার বীজতলায় ৮০-১০০ গ্রাম হারে সমানদূরত্বে বীজ বপন করা উচিৎ। এভাবে এক বর্গ মিটার বীজতলার চারা দিয়ে ২৫-৩০ বর্গমিটার জমিতে রোপণ করা যায়।
🌾 বীজতলা থেকে চারা তোলার ৭ (সাত) দিন পূর্বে বা আগে প্রতি বর্গ মিটার বীজতলার জন্য ৭ (সাত) গ্রাম হারে ইউরিয়া সার ছিটিয়ে তাতে হালকা করে পানি সেচ দেয়া যেতে পারে। এতে করে উৎপাদিত শক্ত-সবল চারা রোপনের পর সহজে, অল্প সময়েই মাটিতে শিকড় গেড়ে লেগে যায়,ও চারা নষ্ট হয় না।
ধানের বীজতলা তৈরি
ধানের বীজতলা তৈরির আগে জেনে নিতে হবে কখন কোন জাতের ধানের বীজ বীজতলায় বপন করতে হয়। চারটি পদ্ধতিতে বীজতলা তৈরি করা যায়। এগুলো হচ্ছে শুকনো, কাদাময়, ভাসমান ও ডাপোগ বীজতলা।
শুকনো বীজতলা
উপযুক্ত আর্দ্রতায় ৫-৬ বার চাষ ও মই দিয়ে মাটিকে একেবারে ঝুরঝুরে করার পর জমি সমান করে শুকনো বীজতলা তৈরি করা যায়। এবার চারাগাছের পরবর্তী পরিচর্যা ও বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য ২৫-৩০ সেন্টিমিটার চওড়া নালা তৈরি হবে। বেডের উপরি ভাগের মাটি ভালোভাবে সমান করার পর শুকনো বীজ সমানভাবে ছিটিয়ে দিন। এরপর উপরের মাটি এমন ভাবে নাড়াচাড়া করতে হবে যেন বীজগুলো ২.৫-৪.০ সেন্টিমিটার (১.০-১.৫ ইঞ্চি) মাটির নিচে চলে যায়। এ কাজকে সহজ করতে ধুলা মাটির আস-রণ দেওয়া যায়। বেডের মাটিতে প্রয়োজনীয় আর্দ্রতা নিশ্চিত করার জন্য নালা ভর্তি করে সেচ দেয়া উচিত।
কাদাময় বা ভেজা বীজতলা
দোঁআশ ও এটেল মাটি এ বীজতলায় জন্য ভাল। আরেকটি কথা, বীজতলার জমি উর্বর হওয়া প্রয়োজন। যদি জমি হয় তাহলে প্রতি বর্গমিটার জমিতে দুই কেজি হারে জৈব সার (পচা গোবর বা আবর্জনা) সুন্দর ভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। এরপর জমিতে ৫-৬ সেন্টিমিটার পানি দিয়ে দু-তিনটি চাষ ও মই দিয়ে ৭ থেকে ১০ দিন রেখে দিন এবং পানি ভালভাবে আটকে রাখুন। আগাছা, খড় ইত্যাদি পচে গেল আবার চাষ ও মই দিয়ে থকথকে কাদাময় করে জমি তৈরি করতে হবে। এবার জমির দৈর্ঘ্য বরাবর ১ মিটার চওড়া বেড তৈরি করতে হবে। বেডের দুই পাশের মাটি দিয়ে বেড তৈরি করা যায়। এরপর বেডের উপরের মাটি বাঁশ বা কাঠের চ্যাপ্টা লাঠি দিয়ে সমান করতে হবে। কাদা বেশি হলে বীজ মাটিতে ডুবে যাবে এবং তাতে ভালভাবে বীজ গজাবে না। এ অবস্থায় বেড তৈরির পৌনে এক ঘন্টা পর বীজ বোনা দরকার। উল্লেখ্য যে, বীজতলা তৈরির জন্য দুই বেডের মাঝে যে নালা তৈরি হলো তা খুবই প্রয়োজন। এ নালা যেমন সেচের কাজে লাগবে তেমনি প্রয়োজনে পানি নিষ্কাশন ও বীজতলার পরিচর্যা করা সহজ হয়।
ভাসমান বীজতলা
বন্যা কবলিত এলাকায় যদি বীজতলা করার মতো উঁচু জায়গা না থাকে বা বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর চারা তৈরির প্রযোজনীয় সময় না পাওয়া যায় তাহলে বন্যার পানি, পুকুর, ডোবা বা খালের পানির উপর বাঁশের চাটাইয়ের মাচা বা কলাগাছের ভেলা করে তার উপর ২-৩ সেন্টিমিটার পরিমাণ কাদার প্রলেপ দিয়ে ভেজা বীজতলার মতো ভাসমান বীজতলা তৈরি করা যায়। বন্যার পানিতে যেন ভেসে না যায় সেজন্য বীজতলা দড়ি বা তার দিয়ে খুঁটির সাথে বেঁধে রাখা দরকার। পানিতে ভাসমান থাকার জন্য এ বীজতলার পানি সেচের দরকার হয় না।
ডাপোগ বীজতলা
বন্যা কবলিত এলাকার জন্য ডাপোগ বীজতলা করা যায়। বাড়ীর উঠান, পাকা বারান্দা বা যে কোন শুকনো জায়গায় চারদিকে মাটি, কাঠ, ইট বা কলাগাছের বাকল দিয়ে চৌকোণা করে নিতে হবে। এবার কলাপাতা বা পলিথিন বিছিয়ে তার উপর ঘন করে অঙ্কুরিত বীজ বুনতে হবে। এ বীজতলার নিচে আচ্ছাদন থাকায় চারাগাছ মাটি থেকে কোনররূপ খাদ্য বা পানি পায় না বলে ৫-৬ ঘন্টা পর পর ভিজিয়ে দিতে হবে এবং দু’সপ্তাহের মধ্যেই চারা তুলে নিয়ে রোপণ করা দরকার। অন্যথায় চারাগাছ খাদ্যের অভাবে মারা যেতে পারে।
বোরো ও আমন ধানের বীজতলা তৈরিঃ
রোদ পড়ে এমন উর্বর ও সেচ সুবিধাযুক্ত জমি বীজতলার জন্য নির্বাচন করতে হবে। চাষের আগে প্রতি বর্গমিটার (প্রায় ১ ফুট x ৩.৫ ফুট) জায়গার জন্য ২-৩ কেজি জৈব সার দিয়ে ভালোভাবে জমি তৈরি করতে হবে। পানি দিয়ে জমি থকথকে কাদা করে এক মিটার চওড়া এবং জমির দৈর্ঘ্য অনুসারে লম্বা করে ভেজা বীজতলা তৈরি করতে হবে।
বোরো ধানের বীজতলা জন্য যেসব এলাকায় ঠান্ডার প্রকোপ বেশি সেখানে শুকনো বীজতলা তৈরি করতে পারেন। প্রতি দুই প্লটের মাঝে ২৫-৩০ সেমি. (প্রায় ১ ফুট) নালা রাখতে হবে।
আবার আমন ধানের বীজতলা জন্য যেসব এলাকায় উঁচু জমি নেই সেসব এলাকায় ভাসমান বীজতলা তৈরী করার জন্য পরামর্শ দেয়া যেতে পারে।
সঠিক সময়ে বীজ বপনঃ
বোরো ধানের বীজতলাঃ ১৫ কার্তিক থেকে ৩০ অগ্রহায়ণ মাসে বোরো ধানের বীজতলা তৈরি করে বীজতলায় বীজ বপনের উপযুক্ত সময়।
আউশ ধানের বীজতলাঃ ১ চৈত্র-১৫ বৈশাখ (মধ্য মার্চ-এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ)।আউশ ধানের বীজতলা তৈরি করে বীজতলায় বীজ বপনের উপযুক্ত সময়।
আমন ধানের বীজতলাঃ আষাঢ়-শ্রাবণ (মধ্য জুন থেকে মধ্য আগষ্ট পর্যন্ত) আমন ধানের বীজতলা তৈরি করে বীজতলায় বীজ বপনের উপযুক্ত সময়।
সঠিক বয়সের চারা রোপণঃ
উত্তমরূপে কাদাময় করে তৈরী জমিতে আউশ মৌসুমে ২০-২৫ দিন, আমন মৌসুমে ২৫-৩০ দিন এবং বোরো মৌসুমে ৩৫-৪৫ দিন বয়সের চারা প্রতি গুছিতে ২-৩ টি করে ২-৩ সেমি গভীরতায় রোপণ করা উচিৎ। বোরো মৌসুমে ধানের চারার বয়স ৪৫ দিনের বেশী হলে, প্রতি দিন বেশী বয়সের জন্য প্রতি হেক্টরে ২০-২৫ কেজি হারে ধানের ফলন কম হতে পারে।
সঠিক সময়ে চারা রোপণঃ –
বোরো মৌসুমে ধানের চারা রোপনের আদর্শ সময় হলো পৌষ থেকে মধ্যে মাঘ ( মধ্যে ডিসেম্বর -জানুয়ারি ) মাসে, তবে ৩১শে জানুয়ারীর পর প্রতিদিন বিলম্বে চারা রোপণের জন্য হেক্টর প্রতি ৫০-৬০ কেজি ধান কম হতে পারে।
আউশ মৌসুমে ধানের চারা রোপনের আদর্শ সময় হলো মধ্য বৈশাখ থেকে শেষ পর্যন্ত (এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে মধ্য মে পর্যন্ত)
রোপা আমন মৌসুমে ধানের চারা রোপনের আদর্শ সময় হলো শ্রাবণ-ভাদ্র (মধ্য জুলাই থেকে মধ্য সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) ধানের চারা রোপনের আদর্শ সময়। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর, আলোক সংবেদনশীল জাতের ধানের চারা ১৫ সেপ্টেম্বর (৩০ ভাদ্র) পর্যন্ত রোপন করা যায়। এর পর চারা রোপন করলে ধানের ফলন কমে যায়।
জমি চাষ দিয়ে তৈরী বীজতলায় বীজ বপন
🥀 দূর থেকে ছিটিয়ে বীজ বোনার ফলে সমান দুরত্বে বীজ পড়েনা।
🥀 ঘন/দলাদলা বা পাতলাভাবে বীজ পড়লে বীজতলার সব জায়গায় সমান হারে চারা গজায়না।
🥀 বীজতলা সমতল করে তৈরী করা যায় না, ফলে উঁচু স্থানে বোনা বীজ শুকিয়ে এবং গর্ত/নিচু স্থানে বোনা বীজ পঁচে বপনকৃত বীজের ২০-৪০% নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
🥀 ঠিকমত পরিচর্যা করা যায়না বিধায় ধানের চারাও অসুস্থ এবং দূর্বল হয়।
যোগাযোগঃ
কৃষি বিষয়ক যে কোন সমস্যার সমাধান ও ফসলের রােগবালাই এবং পােকামাকড় দমনে সঠিক পরামর্শ দিতে আপনার পাশে রয়েছে ekrishi24.অথবা নিকটস্থ “কৃষক তথ্য ও পরামর্শ কেন্দ্র (ফিয়াক)” অথবা “উপ সহকারী কৃষি অফিসার” এর সাথে যোগাযোগ করুন।