সবজি ফসলে ব্যাক্টেরিয়াজনিত ঢলে পড়া রোগ
সবজি ফসলে ব্যাক্টেরিয়াজনিত ঢলে পড়া রোগ নিয়ে আলোচনাঃ-
দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ। লকলক করে বেড়ে উঠছে গাছগুলো। সপ্নভূক কৃষকের মুখে প্রানজুড়ানো হাসি। সার, সেচ, নিড়ানী যত্ন-আত্নীর কমতি নেই। গাছগুলোতে ফুল আসতে শুরু করেছে মাত্র। কদিন বাদেয় থোকা থোকা ফলে ভরে উঠবে ফসলের মাঠ। কিন্তু হঠাত দেখা যায়, জমিতে দু একটি করে গাছ মারা যাচ্ছে। দাগ, পচন বা অন্য কোন লক্ষন নেই। চাষীর কপালে চিন্তার ভাজ। শংকা বাসা বাধে মনে। তবুও আশাবাদী কৃষক মৃত গাছটি তুলে শুন্য জায়গায় নতুন একটি গাছ লাগিয়ে দেয়। নানাজনের পরামর্শে বাজারের যাবতীয় ছত্রাকনাশক স্প্রে করে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়না। কিছুদিনের মাঝেই সবুজ মাঠ বিরানভূমিতে পরিনত হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় এ রোগটির প্রকোপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন দেশের নানা প্রান্ত থেকে কৃষকরা এ রোগটি দমনে করনীয় সম্পর্কে জানতে চাচ্ছেন। অনেকে গাছের নমুনা নিয়ে আসছেন। অনেক অঞ্চলে আক্রমনের মাত্রা ব্যাপক হওয়ায় কৃষকরা শংকিত হয়ে পড়েছেন।
♥রোগের কারণ
√টমেটো, বেগুন, আলুসহ অনেক সবজি ফসলে ব্যাক্টেরিয়াজনিত ঢলে পড়া রোগ দেখা দেয়।
√ছত্রাক /ব্যাকটেরিয়া যে কোনটির আক্রমণে আলু/টমেটোর এই রোগ দেখা দেয়।
√বাড়ন্ত বা চারা অবস্থায় কান্ড /পাতায় এই রোগের আক্রমণ হয়।
√রালস্টোনিয়া নামক মাটি বাহিত ব্যাক্টেরিয়ার কারণে জমিতে এ রোগের আক্রমন দেখা যায়।
√মাটিতে নেমাটোড বা কৃমি থাকলে ঢলে পড়া রোগ বেশী হয়।
√ এটি একটি মাটিবাহিত রোগ, মানে রোগের জীবানু মাটিতে থাকে।
√সাধারনত ক্ষারীয় মাটিতে রোগের প্রকোপ বেশী দেখা দেয়।
√মাটির তাপমাত্রা বেশী হলে রোগের আক্রমন বেশী হয়।
√সেচের পানির মাধ্যমে জীবানু চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে ও নতুন গাছে আক্রমন করে।
√এ সময় প্লাবন সেচ দেয়া।
√ জমিতে ইউরিয়া সার বেশি দিলে এবং এমওপি ও টিএসপি সার কম দিলে রোগ বেশী হয়।
√ কৃমি গাছের শিকড়ে ক্ষত (ইঞ্জুরি) করে, এই ক্ষতস্থান দিয়ে ব্যাক্টেরিয়া গাছের ভিতর প্রবেশ করে।
√জীবানু গাছের শিকড়ের ক্ষতস্থান দিয়ে গাছের কান্ডের (ভাস্কুলার বান্ডেল) ভিতর প্রবেশ করে। এবং কান্ডের ভিতর পানি চলাচলের রাস্তাকে (জাইলেম ভেসেল) ব্লক করে দেয়। অনেকটা মানুষের হার্টের ব্লকের মতো। ফলে পানি গাছের শিকড় থেকে উপরে যেতে পারেনা এবং গাছ ঢলে পড়ে বা নেতিয়ে পড়ে। দু একদিনের মাঝে গাছটি মারা যায়।
√আক্রান্ত গাছ তুলে মাটিতে পুতে না ফেলা। আক্রান্ত স্থানের মাটি সরিয়ে না ফেলা, এবং নতুন মাটি দিয়ে নতুন করে গাছ না লাগানো।
![]() |
| ekrishi24,সবজি ফসলে ব্যাক্টেরিয়াজনিত ঢলে পড়া রোগ |
♥রোগের লক্ষণঃ-
১.টমেটো, বেগুন, আলুসহ অনেক সবজি ফসলে ব্যাক্টেরিয়াজনিত ঢলে পড়া রোগ দেখা দেয়।
২.প্রথমে কচি পাতা বা নিচের বয়স্ক পাতা বির্বণ হয়ে যায়।
৩.প্রথম দিক গাছের কিছু অংশ পরে পুরো গাছ ঢলে পড়ে। আক্রান্ত গাছের কান্ড কালো বাদামি রঙ ধারণ করে।পাশাপাশি পানি গ্রহণে বাধা দেয়।
৪.এ রোগের আক্রমনে প্রথমে গাছের উপরের দিকের কিছু পাতা নেতিয়ে পড়ে, দু একদিনের মধ্যে পুরো গাছ ঢলে পড়ে ও মারা যায়।
৫.এ রোগে গাছের শিকড়, মূল, কান্ড বা অন্য কোথাও পচন দেখা দেয় না।
৬.সম্পূর্ণ গাছ ঢলে পড়ে।
৭. আক্রান্ত গাছের কান্ড কেটে আঙুল দিয়ে চাপ দিলে তরল আঠালো পদার্থ (ব্যাক্টেরিয়া) বের হয়।
৮. সাধারনত গাছের বাড়ন্ত অবস্থায় যখন ফুল ফল আসতে শুরু করে তখন রোগের আক্রমন ব্যাপক হয়।
♦বিস্তারঃ
উষ্ণ ও শুষ্ক আবহাওয়ায় রোগ বেশি হয়।মাটির উষ্ণতা ও আর্দ্রতার ওপর রোগের বিস্তার নির্ভর করে। ভেজা ও কম বাতাসযুক্ত মাটি রোগ সংক্রমণের উপযোগী। বাতাস, পানির মাধ্যমে ছড়াতে পারে।
♥পরীক্ষা
☞ছত্রাক হলে- গাছের কোন ডাল/অংশ থেকে অাক্রমণ শুরু হলে বুঝতে হবে ছত্রাকের অাক্রমণ। আক্রান্ত গাছের কাণ্ডের ভেতরের অংশ বাদামী রঙের হয়ে যায়। গাছের গোড়ার প্রায় ২ ইঞ্চি ডাল কেটে পানিতে ৫-১০ মিনিট ভিজিয়ে রাখলে কাটা অংশ হতে কোন রস বের না হয় ,পানির রঙের কোন পরিবর্তন না হয় তাহলে ছত্রাকের আক্রমণ বুঝতে হবে।
☞ব্যাকটেরিয়া হলে-
আক্রান্ত গাছের গোড়ার প্রায় ২ ইঞ্চি ডাল কেটে পানিতে ৫-১০ মিনিট ভিজিয়ে রাখলে সাদা কষের মত তরল পদার্থ(ব্যাক্টেরিয়াল উজ)বেরিয়ে আসে, যাতে পানির রং সাদা হয়ে যায়। আক্রান্ত গাছ সকালে সুস্থ দেখালেও বিকেলে ঢলে পড়ে৷
♥প্রতিরোধ
১.রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে।
২. মাটি ও বীজ শোধন করতে হবে।
৩.জমি আগাছামুক্ত পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।।
৪.বন বেগুনের সাথে জোড় কলমকরে চারা রোপন করলে রোগ প্রতিরোধী হয়।
৫.ইউরিয়া সার কম দিতে হবে
৬.এমপি ও টিএসপি সার পরিমাণ দিতে হবে।
৭.এ সময় প্লাবন সেচ দেয়া যাবে না, শুধুমাত্র গাছের গোড়ায় পানি দিতে হবে।
৮.আক্রান্ত গাছ তুলে মাটিতে পুতে ফেলতে হবে। আক্রান্ত স্থানের মাটি সরিয়ে ফেলে, নতুন মাটি দিয়ে নতুন করে গাছ লাগাতে হবে।
৯.চারা লাগানোর আগে প্রতি লিটার পানিতে ৩ গ্রাম কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক অথবা ৪ গ্রাম ট্রাইকোডারমা ভিরিডি মিশিয়ে ১৫-২০ মিনিট ধরে চারা শোধন করতে হবে।
১০.চারা লাগানোর ২০-২৫ দিন আগে জমিতে ব্লিচিং পাউডার বিঘা প্রতি ২.৬ কেজি ব্যবহার করতে হবে।
১১.জমিতে ভুট্টা দ্বারা আন্তঃফসল চাষ করলে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ কম হয়।
১২.জমিতে চারা লাগানোর আগে মাটিতে চারা লাগানোর স্থানে প্রতি পিটে এক চিমটি বা ৫-১০ গ্রাম ফুরাডান ৫ জি মিশিয়ে দিতে হবে। এতে মাটিতে বিদ্যমান কৃমি ও কাটুই পোকা মারা যাবে।
♥আগাম প্রতিরোধঃ-
সবজি ফসলে এরোগের প্রতিরোধী জাত খুব কম। কিছু সহনশীল জাত রয়েছে। জমি চাষের সময় ব্লিচিং পাউডার ১৫-২০ কেজি/হেক্টর মাটির সাথে মিশিয়ে দিলে মাটিতে বিদ্যমান ব্যাক্টেরিয়া মারা যায়। গাছের চারা লাগানোর আগে চারার গোড়ার অংশ কপার জাতীয় ছত্রাকনাশক বা অনুমোদিত
ব্যাক্টেরিয়ানাশকের দ্রবনে ১৫-২০ মিনিট ডুবিয়ে রেখে লাগাতে হবে। জমিতে চারা লাগানোর আগে মাটিতে চারা লাগানোর স্থানে এক চিমটি ৫-১০ গ্রাম/ পিট ফুরাডান ৫ জি মিশিয়ে দিতে হবে। এতে মাটিতে বিদ্যমান কৃমি ও কাটুই পোকা মারা যাবে।
![]() |
| ekrishi24,সবজি ফসলে ব্যাক্টেরিয়াজনিত ঢলে পড়া রোগ |
>>আক্রান্ত জমিতে পরবর্তীতে ২-৩ বছর আলু, টমেটো, বেগুন, মরিচ, তামাক ইত্যাদি জাতীয় ফসল চাষ না করা।
>>তিনটি কারনে এ রোগটি দমন বেশ কষ্টসাধ্য। প্রথমত রোগের জীবানু মাটিতে সুরক্ষিতভাবে থাকে। দ্বিতীয়ত, জীবাণু গাছের কান্ডের ভিতর থাকায় বালাইনাশকের সরাসরি সংস্পর্শে আসে না। তৃতীয়ত, বাজারে কার্যত খুব ভালোমানের ব্যাক্টেরিয়ানাশক নেই। তাই এই রোগ দমনে প্রতিকার অপেক্ষা প্রতিরোধ শ্রেয়।
♥প্রতিকার
১.ছত্রাকের আক্রমণ হলে ম্যানকোজেব অথবা কার্বেন্ডাজিম জাতীয় ছত্রানাশক ৭ দিন পরপর ৩ বার গাছের গোড়ায় ও মাটিতে স্প্রে করুন।
২.আক্রমণ বোশি হলে প্রথম থেকে প্রতি লিটার পানিতে ২গ্রাম রোভরাল মিশিয়ে স্প্রে করুন।
এছাড়া কপার গ্রুপের ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা যাবে।
৩.এ রোগ দেখা মাত্র আক্রান্ত জমিতে সেচ প্রদান, নিড়ানী দেওয়া, মালচিং ইত্যাদি বন্ধ রাখতে হবে।
৪.কপার জাতীয় ছত্রাকনাশকে ব্যাক্টেরিয়া প্রতিরোধী উপাদান রয়েছে। তাই কপার অক্সিক্লোরাইড গ্রুপের সালকক্স/ ব্লিটক্স/ সানভিট/ ডিলাইট/ হোসাকপ ছত্রাকনাশক ৭-৮ গ্রাম প্রতি কেজি পানিতে মিশিয়ে গাছের গোড়ার মাটি ভিজিয়ে দিলে রোগ কমে আসে।
♥ব্যাক্টেরিয়া নাশকঃ-
সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ব্যাক্টেরিয়ানাশক বাজারে এসেছে। এগুলো হলো বিসমার্থিওজল গ্রুপের ব্যাকট্রোল/ ব্যাকট্রোবার্ন/ অটোব্যাক – যা ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় স্প্রে করতে হবে। এছাড়াও রয়েছে ইমিডাক্লোরোপিড+ থিরাম + কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের আটাভো/ নাজদা/ টপজিম; কাসুগামাইসিন গ্রুপের কাসুমিন / কায়সার; কোয়ার্ডারটারী এমোনিয়াম গ্রুপের টিমসেন – এগুলো অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করা যেতে পারে। এছাড়াও এন্টিবায়োটিক হিসেবে আছে, ভ্যালিডামাইসিন গ্রুপের ভ্যালিড/ সিনোপা/ নির্ভয় /সিনোম – ১.৫ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রয়োগ করা।
ট্রাই ব্যাসিক কপার সালফেট (কিউপ্রোক্স্যাট ৩৪৫ এসসি) ১ লিটার পানিতে ৫ মিলি হারে মিশিয়ে ৭ দিন পর পর ২-৩ বার জমিতে গাছের গোড়ায় স্প্রে করতে হবে। ব্যাকটেরিয়া নাশক স্ট্রেপ্টোমাইসিন সালফেট + টেট্রাসাইক্লিন হাইড্রোক্লোরাইড (ক্রোসিন-এজি ১০ এসপি) প্রতি লিটার পানিতে ০.৮ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৭ দিন পর পর ২-৩ বার জমিতে গাছের গোড়ায় স্প্রে করতে হবে। ক্রোসিন-এজি ১০ এসপি ও কিউপ্রোক্স্যাট ৩৪৫ এসসি ঔষধ দুইটি পর্যায়ক্রমে ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
এছাড়াও বাজারে বিদ্যমান স্ট্রেপ্টোমাইসিন সালফেট গ্রুপের ব্যাক্টেরিয়ানাশক ক্রোসিন/ আন্টিব্যাক/ ডাইব্যাক্টেরিয়া / বাহা – এগুলো ০.৫ মিলি হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় ২-৩ বার প্রয়োগ করলে সুফল পাওয়া যায়। কপার গ্রুপের একটি ছত্রাকনাশক এবং যেকোন একটি ব্যাক্টেরিয়ানাশক পর্যায়ক্রমে ব্যাবহার করা ভালো। মনে রাখতে হবে, যেকোন ক্যামিকেলই বিষ; এগুলো অবশ্যয় অনুমোদিত মাত্রায় যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে।



