আলুর চাষ পদ্ধতি | আলু চাষ
আলুর আধুনিক চাষ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনাঃ
আলু বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। সাধারণত ধান ও গমের পরই আলুর
স্থান। বর্তমান চাষের জমির পরিমাণ ও ফলনের হিসেবে ধানের পরই আলুর
স্থান।আলু শীতকালে বাংলাদেশের সবগুলি জেলায় ব্যাপকভাবে চাষ করা
হয়। মাটিতে পর্যাপ্ত আর্দ্রতাসহ ভালভাবে সার প্রয়োগকৃত রৌদ্রোজ্জ্বল
জমি আলু লাগানোর জন্য যথোপযুক্ত। উপযুক্ত সময় হচ্ছে নভেম্বরের প্রথম
পক্ষ। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কিছু স্থানে কৃষকগণ আগাম ফসল তোলার জন্য
অক্টোবরে আলু লাগায়।
প্রকৃতপক্ষে, দেশের চাষকৃত আলুর পুরোটাই হাতে লাগানো হয়।
কৃষকগণ মাটির গুণাগুণ ও আলুর জাতের ওপর নির্ভর করে বীজকন্দ ও পাশাপাশি
সারির দূরত্ব নির্ধারণ করে। রোপণের আদর্শ গভীরতা মাটির তাপমাত্রা ও
আর্দ্রতা, রোপণের পরবর্তী সময়ের সম্ভাব্য আবহাওয়া এবং পরবর্তী সময়ে
মাঠ পরিচর্যা পরিচালনার ধরনের ওপর নির্ভর করে।
আলুর পরিচিতিঃ
আলুর ইংরেজি নাম Potato. কথাটি এসেছে স্প্যানিশ শব্দ 'Petata' থেকে।
বাংলা ও ভারতে এই সবজিটি আলু নামে প্রসিদ্ধ।এটি প্রধানত Roots
& tubers জাতীয় খাদ্য।বৈজ্ঞানিক দিক থেকে আলু ম্যাগ্নোলিসিডা
শ্রেণীর অ্যাস্টেরিডা উপশ্রেণী ও সোলানালেস বর্গের
সোলানাসিয়া(Solanaceae) পরিবারের সপুষ্পক উদ্ভিদ।কোন কোন কৃষি
বিজ্ঞানী বলেন মোট চার হাজার ধরনের আলুর চাষ হয়ে থাকে।
আরও বিস্তারিত জানতে নিছে ক্লিক করুন
জাত নির্বাচনঃ
কন্দাল ফসল গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই এ পর্যন্ত আলুর মোট ৮৩টি জাত (যার
মধ্যে বারি আলু হিসেবে ৭৭ টি) অবমুক্ত করেছে। মুক্তায়িত জাতগুলোর মধ্যে
রয়েছে খাবার আলু,প্রক্রিয়াজাতকরণ উপযোগী আলু, রপ্তানীযোগ্য আলু,
রোগপ্রতিরোধী আলু, আগাম আলু ও সাধারন তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায় এমন
আলুর জাত। এদের মধ্য থেকে প্রয়োজন/চাহিদা মোতাবেক জাত নির্বাচন করতে
হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে শতকরা ৮০ ভাগের বেশি জমিতে
ডায়ামন্ট,এস্টারিক্স,কার্ডিনাল, গ্রানোলা ইত্যাদি জাতের আলু চাষ হয়
।
ডায়মন্ড : এটি খারার আলু হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এটির জীবনকাল ৮০-৯০
দিন এবং ফলন প্রতি একরে ১০-১২ টন হয়।
কার্ডিনাল : বহুল ব্যবহৃত খাবার আলু হিসাবে এটি ব্যবহার হচ্ছে। ৮০
থেকে ৯০ দিনের মধ্যে এটি উৎপাদন হয়। ফলন প্রতি একরে ১০-১২ মেট্রিক টন
হয়।
এস্টারিক্স : আলুর এই জাতটি খেতে খুবই সু-স্বাদু এবং উৎপদনও বেশি হয়।
উৎপাদন মেয়াদকাল ৮০-৯০ দিন। ফলন প্রতি একরে ১২-১৪ মেট্রিক টন। এটি
খাবার ও রপ্তানীযোগ্য আলু।
গ্রেনোলা : সবচেয়ে কম সময়ে এই জাতটি উৎপাদন । ফলন প্রতি একরে ১০-১২
মেট্রিক টন। রপ্তানীযোগ্য ও আগাম আলু হিসাবে এটি ব্যবহার হচ্ছে।
কারেজ : এটি খাবার ও রপ্তানীযোগ্য আলু। উৎপাদন মেয়াদকাল ৮০-৯০ দিন।
ফলন প্রতি একরে ১০-১২ মেট্রিক টন । বেশ লাভজন আলুর জাত এটি।
লেডি রোসেটা : এটির জীবনকাল ৮০-৯০ দিন। ফলন প্রতি একরে ১০-১২ মেট্রিক
টন। আলুর এই জাতটি খাবার ও রপ্তানীযোগ্য হিসাবে ব্যবহার করা
হচ্ছে।
বেলিনি : অধিক ফলনশীল এই জাতটি খাবার ও রপ্তানীযোগ্য। এটির ফলন প্রতি
একরে ১২-১৪ মেট্রিক টন। জীবনকাল ৮০-৯০ দিন।
সাগিতা : অধিক ফলনশীল আলু এটি । খাবার ও রপ্তানীযোগ্য আলু হিসাবে এই
জাতটি ব্যবহার হচ্ছে। এটির জীবন কাল ৮০-৯০ দিন। ফলন প্রতি একরে ১২-১৪
মেট্রিক টন।
আলু বীজ প্রস্তুতি
বীজ আলু উৎপাদনের ক্ষেত্রে আস্ত আলু বপন করা ভালো, কারণ আস্ত বীজ
রোপনের পর এগুলোর রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। আলু কেটে লাগলে প্রতি
কর্তিত অংশে অন্তত ২ টি চোখ অবশ্যই রাখতে হবে। আলু কাটার সময় বারবার
সাবান পানি দ্বারা ছুরি বা বটি পরিষ্কার করা উচিত যাতে রোগ জীবাণু এক
বীজ থেকে অন্য বীজে না ছড়ায়। বীজ আলু আড়া আড়ি ভাবে না কেটে
লম্বালম্বিভাবে কাটতে হবে।
"আরও বিস্তারিত জানতে নিছে ক্লিক করুন
আলু বীজ শোধন পদ্ধতি"
আলু বীজ শোধন
অধিক ফলনের জন্য আলু রোপনের পূর্বে আলু বীজ শোধন অতিব জরুরী। বর্তমানে
মাঠে আলু লাগানোর উপযুক্ত সময়। তাই আলু লাগানোর পুর্বে বীজ শোধন করতে
হবে।সাধারণত বীজ দুই ভাবে শোধন করা যায়।
১ম শোধন পদ্ধতি
বীজ প্রত্যয়িত হলে বপনের আগে আর কোনো রকম ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন হয়
না৷ অন্যথায় বীজ শোধন করে নেওয়া ভালো৷ বীজ শোধনের জন্য মারকিউরিক
ক্লোরাইড (Mercuric chloride), ফার্মালডিহাইড (Formaldehyde) অথবা,
ইয়েলো অক্সাইড অব মার্কারি (Yellow oxide of mercury)
ব্যবহার করা যায়৷ উক্ত তরল গুলোতে আলুর বীজকে কিছুক্ষণ চুবিয়ে উঠিয়ে
নিলেই বীজ শোধন হয়ে যায়৷ তবে কাটা বীজ ব্যবহার করতে গেলে কিছু সাবধানতা
অবলম্বন করতে হবে, যেমন-
২য় শোধন পদ্ধতি
বীজ আলু লাগানোর পুর্বে বীজ শোধন করতে কার্বেন্ডাজিম+থিরাম গ্রুপের
অথবা শুধু কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক ব্যবহার করে বীজ শোধন করা
যায়। বীজ শোধনের জন্য যে কোন কৃষক বাজার থেকে বীজ শোধক প্রোভেক্স ,
ভিটাভেক্স, ভিটাফো-২০০ এফ এফ, হাদাক ইত্যাদি পাউডার কিনে প্রতি ১০ কেজি
আলু বীজের জন্য ২৫ থেকে ৩০ গ্রাম পাউডার ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে আলু
বীজ ৫ থেকে ১০ মিনিট পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে।এরপর পানি থেকে তুলে
পরিষ্কার ঠান্ডা পানিতে ধুয়ে ছায়ায় শুকিয়ে জমিতে রোপন করতে হবে । এভাবে
আলু বীজ শোধন করে রোপন করা হলে বীজবাহিত রোগ থেকে আলু রক্ষা করে অধিক
ফলনের নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে।
"আরও বিস্তারিত জানতে নিছে ক্লিক করুন
আলু চাষের জমি তৈরি/বীজ বপনের সঠিক কৌশল"
আলু চাষের মাটি/জমি নির্বাচনঃ
আলু চাষের জন্য হালকা প্রকৃতির মাটি অর্থাৎ দোআঁশ ও বেলে-দোআঁশ মাটি
সব চাইতে বেশী উপযোগী৷কিন্তু এটেল-দোআঁশ মাটিতেও আলুর চাষ করা যায়,তবে
এই রকম মাটিতে আলু খুব একটা ভালো হয় না৷আলুর মাটি সুনিষ্কাশনযুক্ত,গভীর
ও কিছুটা অম্লাত্মক হওয়া চাই৷ PH ৫.৫-৬০ এর মধ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়, এতে
আলুর জন্য ক্ষতিকর রোগ স্কেভিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না৷
আলু রোপণের উপযুক্ত সময়ঃ
বাংলার কার্তিক মাস আলুর জন্য জমি তৈরি ও বীজ বপনের উপযুক্ত
সময়।বাংলাদেশে সাধারণত নভেম্বর মাসের আগে আলু লাগানো যায় না, কারণ তার
আগে জমি তৈরি সম্ভব হয় না। নভেম্বরের পরে আলু লাগালে ফলন কমে যায়। এ
জন্য উত্তরাঞ্চলে মধ্য-কার্তিক (নভেম্বর প্রথম সপ্তাহ), দক্ষিণাঞ্চলে
অগ্রহায়ণ ১ম সপ্তাহ থেকে ২য় সপ্তাহ (নভেম্বর মাসের মধ্য থেকে শেষ
সপ্তাহ)।
আলু চাষের জমি তৈরি পদ্ধতি
আশ্বিন মাস হতে আলুর জমি প্রস্তুতের কাজে হাত দিতে হয়৷ জমির প্রকৃতি
ভেদে ৫/৬ টি চাষ ও কয়েকটি মই দিয়ে ভালোভাবে ওলট-পালট করে নিতে হবে৷
আলুর জমি গভীরভাবে চাষ করা উচিত৷অনেক এলাকার চাষীগণ কোদাল ও লাঙলের
সাহায্যেই জমি গভীরভাবে চাষ করে থাকেন৷ জমি শুধু গভীরভাবে চাষ করলেই হয়
না, মাটি মোলায়েম ও ঝুরঝুরা করে প্রস্তুত করা হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে
হয়৷ ঢেলা যুক্ত ও আঁটসাঁট জমিতে আলুর বৃদ্ধি ব্যাহত হয়৷
আলু চাষে বীজ বপন পদ্ধতির কৌশল
আলু বীজ বপন
আলু বীজ সাধারণত দুই সারি পদ্ধতিতে বপন করা যায়।যেমনঃ
🥔 প্রথম পদ্ধতি
প্রতি সারি বরাবর ৫-৭ সেন্টিমিটার মাটি সরিয়ে নিয়ে নালা প্রস্তুত করা
হয়, তারপর সেই নালাতে নির্দিষ্ট দূরত্বে বীজ বপন করে মাটি দ্বারা বীজ
ঢেকে দেওয়া হয়৷
🥔🥔 দ্বিতীয় পদ্ধতি
সারির মাটি না খুড়ে অর্থাৎ নালা না করে সারির দাগ বরাবর বীজ নির্দিষ্ট
ব্যবধানে বপন করার পর দুই সারির মধ্যবর্তী জায়গা হতে মাটি টেনে উঁচু
করে বীজ ঢেকে দেওয়া হয়৷
আলুর বীজ হারঃ
বীজহার নির্ভর করে রোপণ দূরত্ব ও বীজের আকারের উপর। সাধারণত প্রতি
হেক্টরে ১.৫ থেকে ২ টন বীজ আলুর প্রয়োজন (একরে ৬০০-৮০০ কেজি)।
আলু চাষে বীজ বপন/ রোপণ দূরত্ব:
রোপণের দূরত্ব ৬০ -২৫ সেন্টিমিটার (আস্ত আলু) এবং ৪৫-১৫ সেন্টিমিটার
(কাটা আলু)৷
আলু চাষে বীজের আকার
২৫-৩৫ গ্রাম ওজনের বীজ রোপণ করা সবদিক থেকে ভালো।
উপযুক্ত জলবায়ুঃ
আলু নিতান্তই শীতপ্রধান অঞ্চলের ফসল৷ নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলেও আলু ভালো
জন্মে৷ তবে অ-নিরক্ষীয় অঞ্চলের শীতকালীন মৌসুমে যেমন আমাদের দেশে আলুর
চাষ করা চলে৷ ১৬-২১ ডিগ্রি তাপমাত্রা আলুর জন্য আদর্শ স্থানীয়, তবে গাছ
বৃদ্ধির প্রথম দিকে অধিক তাপ ও শেষ দিকে অর্থাৎ কন্দ ধরা কালীন সময়ে কম
তাপ থাকা বাঞ্ছনীয়৷ অল্প পরিমাণ বরফ পড়াও আলু সহ্য করতে পারে, তবে অধিক
শৈত্যে (-২০ হেত ৩০) কন্দের বৃদ্ধি থেমে যায় ও কোষের গঠন নষ্ট হয়ে যায়৷
মৌসুমে মাঝারি বৃষ্টিপাত ৩০ ইঞ্চি অর্থাৎ ৭৬২ মিলিমিটার আলুর জন্য
উপযোগী৷ অধিক বৃষ্টিপাতে আলু মোটেই ভালো হয় না,গাছের বৃদ্ধি থেমে যায়৷
রোগ ও কীটপতঙ্গের আক্রমণ সহজতর হয়৷ তবে পার্বত্য এলাকায় (১৮৬০-২১৭০
মিলিমিটার) অধিক বৃষ্টিপাত হলেও পানি দ্রুত সরে যায় ও ঠাণ্ডা পরিবেশ
বিরাজমান থাকে বলে সেরূপ পরিবেশে আলুর চাষ করা যায়৷ তাই পশ্চিমবঙ্গের
দার্জিলিং জেলায় এইরূপ পরিবেশে গ্রীষ্মকালে আলু জন্মানো যায়৷
সেচ ব্যবস্থাপনাঃ
এদেশে অনেক চাষী বিশেষ করে যারা দেশী আলুর চাষ করেন তারা আলুর
জমিতে সেচের পানি ব্যবহার করতে চান না৷ কিন্তু অধিক ফলনশীল আলুর জাতে
অধিক সার ব্যবহার করলে আলুর জমিতে পরিমাণ মতো পানি ব্যবহার করা আবশ্যক৷
আলুর জমিতে সেচ দেওয়া বেশ সুবিধাজনক৷ সারিতে গাছের গোড়ায় মাটি উঁচু করে
দেওয়ার ফলে যে জুলি বা নালার সৃষ্টি হয় তার মধ্যে পানি প্রবেশ করিয়ে
দিলেই সারা ক্ষেত পানিতে সিক্ত হয়ে যায়৷ আলুর জমি সব সময় রসযুক্ত থাকবে
সেই বিবেচনায় আলু ক্ষেতে নিয়মিত পানি সেচ দিতে হবে৷
মাটির প্রকারভেদের উপর নির্ভর করে ২/৩ বার সেচ দিলেই চলবে৷ অধিক
সেচে কোনো লাভ নেই, তাতে বরং উপকারের চাইতে অপকারই হবে৷ এই অবস্থায়
গাছে ছোট ছোট নিম্নমানের আলু ধরবে৷ আবার অনিয়মিত পানি ব্যবহার করলে
গুটি যুক্ত ফাঁপা ধরনের আলু জন্মাবার সম্ভাবনা থাকে৷ আলু উঠানোর দুই
সপ্তাহ পূর্ব হতে সেচ বন্ধ করে দিতে হবে৷ এতে আলুর পূর্ণতা প্রাপ্তি
হবে৷
সেচ প্রয়োগঃ-১
বীজ রোপণের পর জমিতে পরিমিত রস না থাকলে সেচ দেওয়া উত্তম, তবে খেয়াল
রাখতে হবে ক্ষেতে কোনভাবেই পানি না দাঁড়ায়। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন
পানিতে নালা/ভেলির ২/৩ অংশ পর্যন্ত ডুবে যায়।
সেচ প্রয়োগঃ-২
স্টোলন বের হওয়ার সময় ২০-২৫ দিনের মধ্যে দ্বিতীয় সেচ প্রয়োগ করতে
হবে।
উল্লেখ্য যে, দাঁদ রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য আলু রোপণের পর ৩০-৫০ দিনের সময়ে জমিতে কোন অবস্থায় রসের ঘাটতি এবং ৬০-৬৫ দিনের পর রসের আধিক্য হতে দেয়া যাবে না।
সেচ প্রয়োগঃ-৩
৪০-৪৫ দিনের মধ্যে গুটি বের হওয়া পর্যন্ত এবং পরে আলু বৃদ্ধির সময়
তৃতীয় বার সেচ দিতে হবে। জমি থেকে আলু উঠানোর ৭-১০ দিন পূর্বে মাটি
ভেদে সেচ প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।
সারের প্রয়োগের পরিমাণ:
দেশের বিভিন্ন স্থানের মাটির উর্বরতা বিভিন্ন রকমের এজন্য সারের
চাহিদা সকল জমির জন্য সমান নয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল,
ফার্মগেট, ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত “সার সুপারিশ গাইড” অনুযায়ী বিভিন্ন
অঞ্চলের জন্য প্রয়োজনীয় সার ব্যবহার করতে হবে।
সার প্রয়োগ
দুটি কারণে আলুতে সুষম সার প্রয়োগ অত্যাবশ্যক।
প্রথমত: সুষম সার প্রয়োগ করলে আলুর উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং উৎপাদিত বীজ
আলুর গুণগত মান ভালো হয়।
দ্বিতীয়ত: গাছে কোনো খাদ্য উপাদানের অভাব জনিত লক্ষণ সৃষ্টি হলে আলু
গাছে ভাইরাস রোগের উপস্থিতি / লক্ষণ সনাক্ত করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
সার প্রয়োগ মাত্রা
| সারের নাম | সারের পরিমাণ | ||
|---|---|---|---|
| শতকে/কেজি | বিঘায়/কেজি | প্রতি হেক্টরে | |
| গোবর | ৪১ | ১৩৭৮ | ১০ টন |
| ইউরিয়া | ১.৩২ - ১.৪২ | ৪৪.৭৮ - ৪৮.২৩ | ৩২৫ - ৩৫০ কেজি |
| টিএসপি | ০.৮১ - ০.৮৯ | ২৭.৫৬ - ৩০.৩২ | ২০০ - ২২০ কেজি |
| এমপি | ০.৮৯ - ১.০১ | ৩০.৩২ - ৩৪.৪৫ | ২২০ - ২৫০ কেজি |
| জিপসাম | ০.৪০ - ০.৪৯ | ১৩.৭৮ - ১৬.৫৪ | ১০০ - ১২০ কেজি |
| জিংক সালফেট | ০.০৩২ - ০.০৪০ | ১.১০ - ১.৩৮ | ৮ - ১০ কেজি |
| বোরন (প্রয়োজনবোধে) | ০.০২৪ - ০.০৩২ | ০.৮৩ - ১.১০ | ৬ - ৮ কেজি |
মাটিতে ঔষধ প্রয়োগ :
ব্যাকটেরিয়া জনিত ঢলে পড়া রোগ প্রতিরোধের জন্য শেষ চাষের পূর্বে প্রতি
শতাংশ জমিতে ৮০ গ্রাম স্টেবল ব্লিচিং পাউডার মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া
উত্তম।
সার প্রয়োগ পদ্ধতি:
গোবর ও জিংক সালফেট শেষ চাষের সময় জমিতে মিশিয়ে দিতে হবে। অর্ধেক
ইউরিয়া, সম্পূর্ণ টিএসপি, এমপি, জিপসাম ও বোরন সার রোপণের সময় সারির
দুই পার্শ্বে বা জমিতে মিশিয়ে দিতে হবে।এবং প্রথমবার ইউরিয়া দেবার পর
বাকি ইউরিয়া রোপণের ৩০-৩৫ দিন পর অর্থাৎ দ্বিতীয়বার মাটি তোলার সময়
উপরি প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের পর সাথে সাথে সার ও বীজ মাটি দিয়ে
ভেলি তুলে ঢেকে দিতে হবে।
আগাছা দমনঃ
বীজ বপনের ৬০ দিন পর্যন্ত আলুর ক্ষেত আগাছা মুক্ত রাখতে হয়৷ আলুর
জমিতে আগাছা দমন আলাদাভাবে করার প্রয়োজন পড়ে না৷ গাছের গোড়ায় মাটি তুলে
দেয়া ও গোঁড়ার মাটি আলগা করে দেয়ার সময়ই আগাছা দমন হয়ে যায়৷
আলুর চাষাবাদ পদ্ধতির মধ্যে অন্যতম হলো পোকার আক্রমণ ও রোগ-বালাই দমন
করা।
আরও ক্ষতিকর পোকা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে নিছে ক্লিক করুন
আলুর ক্ষতিকর পোকা। যেমনঃ
২) আলুর সুতলী পোকা
৩)
আরও ক্ষতিকর রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে নিছে ক্লিক
করুন
আলুর রোগ-বালাই।যেমনঃ
৪) আলুর স্টেম ক্যাষ্কার স্কার্ফ রোগের
৫) ঢলে পড়া এবং বাদামি পচন রোগ
৬) আলুর দাদ রোগ
৭) আলুর পাতা মোড়ানো রোগ
৮) আলুর মোজাইক রোগ
৯) আলুর হলদে রোগ
১০) আলুর শুকনো পচা রোগ
১১) আলুর নরম পচা রোগ
আলুর অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা
আলু গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দেয়াঃ
আলু লাগানোর ৩০-৩৫ দিন পর গোড়ায় মাটি দেওয়া প্রয়োজন৷ জমিতে আলুর গাছ
যখন ৫-৬ ইঞ্চি অর্থাৎ ১২-১৫ সেন্টিমিটার হয় তখন দুই সারির মাঝখানের
মাটি হালকাভাবে কুপিয়ে নরম ঝুরঝুরা করে নিতে হয়৷ এই সময় জমির আগাছা
নিধনের কাজও হয়ে যায়৷ নরম ঝুরঝুরা মাটি কোদালি দ্বারা টেনে সারিতে
গাছের দুই দিকে দেওয়া হয়৷ এর তিন সপ্তাহ পর গোড়ায় আবার মাটি দিতে হয়৷
গাছের বৃদ্ধি বেশি হলে আর একবার অর্থাৎ তৃতীয়বারের মতো মাটি দেওয়া হয়৷
গাছের গোড়ায় এইভাবে মাটি দিলে গাছের স্টোলনগুলো টিউবার অর্থাৎ আলুতে
পরিণত হবার সুযোগ পায়৷ মাটি ঠিকমতো দেওয়া না হলে বর্ধিষ্ণু আলু মাটির
বাইরে এসে সবুজ রং ধারণ করে৷ এ রকম আলু খাবার অনুপোযোগী এবং কখনো কখনো
তা বিষাক্তও হতে পারে৷
রোগিংঃ
মানসম্পন্ন বীজ আলু উৎপাদনে রোগিং একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সঠিকভাবে রোগিং করা না হলে বীজ আলুর গুণাগুণ কমে যায়। এ জন্য গাছের বয়স
৩০-৩৫ দিন থেকে শুরু করে ফসল সংগ্রহ পর্যন্ত নিয়মিত আলুর জমিতে বিভিন্ন
জাতের মিশ্রিত গাছ, অস্বাভাবিক এবং রোগাক্রান্ত গাছ তুলে ফেলতে
হবে। ভাইরাস রোগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সর্তকতার সাথে আলু গাছ মাটির
নিচে আলুসহ উঠিয়ে অন্যত্র মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে। সকালে এবং
বিকালে রোগিং এর জন্য উপযুক্ত সময়। সুর্যের বিপরীত দিকে মুখ করে রোগিং
করতে হবে যেন পাতায় সকল লক্ষণ স্পষ্ট বুঝা যায়। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন
রোগাক্রান্ত গাছ কোনক্রমেই কোন সুস্থ গাছের সঙ্গে না লাগে এবং শ্রমিকের
হাতের স্পর্শ দ্বারাও যেন সুস্থ গাছ রোগ সংক্রমণ না হয়। বীজ ফসলের
ক্ষেতে বীজ আলু মাটি ভেদ করে উঠে আসার পর থেকে হাম পুলিং পর্যন্ত ৪/৫
দিন অন্তর অন্তর ফসলের মাঠে যেয়ে রোগিং করতে হবে। রোগমুক্ত মানসম্পন্ন
আলু উৎপাদন করায় রপ্তানিযোগ্য আলু উৎপাদনের ক্ষেত্রেও এ পদ্ধতি অনুসরণ
করা দরকার।
আলুর পরিপক্বতার লক্ষণঃ
যখন দেখা যাবে আলু গাছগুলো হলুদ হয়ে মরে যাচ্ছে তখনই বুঝতে হবে আলু
তোলার উপযুক্ত সময় হয়েছে৷ সাধারণত আলুবীজ লাগাবার ৩ থেকে ৪ মাসের
মধ্যেই এ আলু তোলা যায়৷ উচ্চফলনশীল জাতে ৮০-১০০ দিন লাগে পরিপক্বতা
আসতে। দেশি জাতে সময় আরো বেশি লাগে।
হামপুলিং বা গাছ উপড়ে ফেলাঃ
মাটির উপরে গাছের সম্পূর্ণ অংশকে টেনে উপড়ে ফেলাকে হাম পুলিং
বলে।হামপুলিং এর ৭-১০ দিন পূর্ব হতে সেচ বন্ধ করতে হবে। তবে বালি মাটি
হলে ৫-৭ দিন পূর্বে সেচ বন্ধ করা ভালো।হামপুলিং করার সময় মাটিতে
পর্যাপ্ত রস থাকলে গাছ ক্ষেত থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে।যদি পর্যাপ্ত রস না
থাকে তবে গাছ দ্বারা পিলি ঢেকে দিতে হবে। যাতে হিট ইনজুরি হওয়ার
সম্ভাবনা কমে যাবে। ফসল কর্তন (Crop Cutting) করে আলুর আকার ও ফলন দেখে
হামপুলিং এর তারিখ নির্ধারণ করতে হবে।
মাঠে মাটির নিচে কিউরিংঃ
আলু সংগ্রহের ৭-১০ দিন পূর্বে হাম পুলিং করতে হবে। এতে সম্পূর্ণ
শিকড়সহ গাছ উপরে আসবে কিন্তু আলু মাটির নিচের থেকে যাবে।হাম পুলিং এর
ফলে আলুর ত্বক শক্ত হয়।ত্বক শক্ত হয়েছে কিনা তা দেখার জন্য আলু তুলে
বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা আলুর ত্বকে চাপ দিতে হবে। চামড়া না উঠলে বুঝা যাবে
কিউরিং হয়েছে। অথবা চটের বস্তায় ২/৩ কেজি নমুনা আলু উঠিয়ে ঝাকুনি দিতে
হবে। যদি ছাল না উঠে তবে বুঝা যাবে কিউরিং হয়েছে। বীজআলু মাটির নিচে
থাকা অবস্থায় প্রয়োজনে লাইনে মাটি দিয়ে আলু ঢেকে দিতে হবে যেন
সূর্যালোকে আলুতে সবুজায়ন ও হিট ইনজুরি না হতে পারে।
বীজ আলুতে অবশ্যই হাম পুলিং করতে হবে, তবে খাবার আলুর বেলায় হাম পুলিং জরুরি নয়।
"আরও বিস্তারিত জানতে নিছে ক্লিক করুন
আলু বাড়ীতে / হিমাগারে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পদ্ধতি"
জমি থেকে আলু সংগ্রহঃ
আলুর সারিতে কোদালের সাহয্যে বা লাঙল চালিয়ে আলু মাটি থেকে তোলা হয়৷
তবে আলু তোলার সময় সতর্ক থাকতে হবে যাতে আলু কেটে বা থেতলিয়ে না যায়,
কেননা আলু থেতলিয়ে গেলে সংরক্ষণ করার সময় পচে যায়৷সেজন্য বড় কৃষকরা
সতর্কতার সাথে আলু সংগ্রহ করে সংরক্ষণের জন্য সাধারণত হিমাগার অর্থাৎ
কোল্ড স্টোরেজে ব্যবহার করেন।আবার অনেক প্রান্তিক কৃষক বাড়ীতেই আলু
সংরক্ষণ করেন।কিন্তু অনেক সময় সংরক্ষণ পদ্ধতি সঠিক না হওয়ার কারণে আলু
পচে যায়।
সর্টিং-গ্রেডিংঃ
আলু সংরক্ষণ করার জন্য অবশ্যই ভালোভাবে বাছাই করা দরকার। বাছাই ভাল
হলে সংরক্ষণ/ রপ্তানিযোগ্য আলুর মান ভাল হবে। রোগাক্রান্ত,
আঘাতপ্রাপ্ত, আংশিক কাটা, ফাটা, অসম আকৃতির ও অতীব সবুজায়নকৃত আলু
সঠিকভাবে বাছাই করে পরে বস্তাবন্দী করতে হবে। বাছাইকৃত আলুতে দু-একটি
রোগাক্রান্ত বা খারাপ আলু থাকলে অবশিষ্ট আলুর মান ক্ষতিগ্রস্থ হবে এবং
আলু রপ্তানির সময় নষ্ট হয়ে যাবে।
আলুর গুদাম পর্যবেক্ষণঃ
১৫ দিন পর পর গুদামে বা পাত্রে সংরক্ষিত আলু দেখতে হবে। খারাপ গìধ হলে
বুঝতে হবে দু-একটি আলু পচেছে। পচা আলু সরাতে হবে। ইঁদুরের কোনো চিহ্ন
দেখলে বা টের পেলে ইঁদুর মারার ব্যবস্খা করতে হবে। স্তূপের নিচের আলু
ওপরে এবং ওপরের আলু নিচে নেড়ে দিতে হবে। আলু ভিজে গেলে হালকা রোদে
শুকিয়ে আবার গুদামজাত করতে হবে।
যে কাজগুলো করা যাবে নাঃ
গুদাম ঘরে অল্প জায়গায় অধিক পরিমাণ আলু রাখা যাবে না। এতে
অক্সিজেনের অভাব হয়। ফলে সংরক্ষিত আলুতে কালো দাগ রোগ দেখা দিতে পারে।
আলুতে সূর্যের আলো পড়তে দেয়া যাবে না। আলো পরলে আলু সবুজ রংয়ের হয় এবং
চামড়ায় বিষাক্ত পদার্থের সৃষ্টি হয়।
সর্তকতাঃ
সংরক্ষিত আলু যেহেতু সরাসরি খাবার আলু হিসেবে ব্যবহুত হবে সেজন্য
সংরক্ষনের সময়ে কোনো কীটনাশক ব্যবহার করা ঠিক হবে না বা সংরক্ষণের আগে
কোনো কীনাশকে চোবানো যাবে না।
আলুর ফলনঃ
বাংলাদেশে উচ্চফলনশীল জাতের জাতভেদে হেক্টরপ্রতি ফলন ৩০-৪৫ টন পর্যন্ত
হয় এবং দেশি জাতে ১০-১২ টন। বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষ করলে উচ্চফলনশীল জাতে
৩৫-৪০ টনের অধিক ফলন পাওয়া সম্ভব।
যোগাযোগঃ
কৃষি বিষয়ক যে কোন সমস্যার সমাধান ও ফসলের রােগবালাই এবং পােকামাকড়
দমনে সঠিক পরামর্শ দিতে আপনার পাশে রয়েছে ekrishi24.অথবা নিকটস্থ
“কৃষক তথ্য ও পরামর্শ কেন্দ্র (ফিয়াক)” অথবা “উপ- সহকারী কৃষি অফিসার”
এর সাথে যোগাযোগ করুন।