সয়াবিন চাষাবাদ
সয়াবিন চাষাবাদ পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা
পরিচিতি
সয়াবিন Leguminosae পরিবারের যার ইংরেজি নাম Soybean এবং বৈজ্ঞানিক নাম Glycine max.
সয়াবিন বাংলাদেশে ফসল হিসেবে এখনও জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি কিন্তু সয়াবিন তেল ভোজ্যতেল হিসেবে খুবই জনপ্রিয়। বাংলাদেশে সয়াবিন তেল সবটাই বিদেশ থেকে আমদানী করা হয়। কোন কোন সময় অপরিশোধিত সয়াবিন তেল বিদেশ থেকে নিয়ে এসে এখানে পরিশোধিত করে বাজারজাত করা হয়।
সয়াবিন বাংলাদেশে ফসল হিসেবে এখনও জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি কিন্তু সয়াবিন তেল ভোজ্যতেল হিসেবে খুবই জনপ্রিয়। বাংলাদেশে সয়াবিন তেল সবটাই বিদেশ থেকে আমদানী করা হয়। কোন কোন সময় অপরিশোধিত সয়াবিন তেল বিদেশ থেকে নিয়ে এসে এখানে পরিশোধিত করে বাজারজাত করা হয়।
সয়াবিন বিশ্বের অন্যতম প্রধান তেলবীজ ফসল। বর্তমানে বাংলাদেশে যা সয়াবিন উৎপাদিত হয় তা চাহিদার এক পঞ্চমাংশ মাত্র। এ চাহিদাকে সামনে রেখে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এর বিজ্ঞানীগণের উন্নত জাত উদ্ভাবনের চেষ্টার অংশ হিসাবে সয়াবিনের একটি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছেন যা “বিনাসয়াবিন-২” নামে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক বাণিজ্যিকভাবে সারাবছর চাষাবাদের জন্য ছাড়পত্র পেয়েছে । এ জাতটি প্রধান বৈশিষ্ট সম্পর্কে জাতটির প্রধান উদ্ভাবক উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ড. মোঃ আব্দুল মালেক, বলেন- উচ্চ ফলনশীল জাত।
বৈশিষ্ট্যঃ
গাছের উচ্চতা রবি মৌসুমে ২৭-৪০ সে.মি. এবং খরিফ-২ মৌসুমে ৩৫-৪২ সে.মি.। প্রাথমিক শাখার সংখ্যা ৩-৫টি। প্রতি গাছে ফলের সংখ্যা ৪০-৫০টি। বীজ আকারে মাঝারি ধরণের এবং ১০০ বীজের ওজন ১৩.০-১৩.৮ গ্রাম। বীজে আমিষ, তেল এবং শর্করার পরিমাণ যথাক্রমে ৪৩, ১৯ এবং ২৬%।
জীবনকালঃ
রবি এবং খরিফ-২ মৌসুমে জীবনকাল যথাক্রমে ১১৫ এবং ১১৭ দিন। রবি এবং খরিফ-২ মৌসুমে যথাক্রমে ২.৫-২.৮ এবং ২.৭-৩.৩ টন/হে. ফলন পাওয়া যায়।
বীজের হার:
সারিতে বপনের ক্ষেত্রে প্রতি একরে ২২ কেজি (হেক্টরে ৫৫ কেজি) এবং ছিটিয়ে বপনের ক্ষেত্রে প্রতি একরে ২৮ কেজি (হেক্টরে ৭০ কেজি)।
মাটি ও আবহাওয়া:
রবি এবং খরিফ উভয় মৌসুমেই সয়াবীন চাষ উপযোগী। বেলে দো-আঁশ, দো-আঁশ ও এটেল দো-আঁশ মাটিতে সয়াবীন চাষ করা যায়। খরিফ মৌসুমের জন্য উঁচু ও পানি নিষ্কাশনযোগ্য জমি এবং রবি মৌসুমের জন্য মাঝারি থেকে নিচু জমি নির্বাচন করতে হবে। নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, ভোলা, যশোহর, ময়মনসিংহ অঞ্চল সয়াবিন চাষের জন্য উপযোগী এলাকা
রবি এবং খরিফ উভয় মৌসুমেই সয়াবীন চাষ উপযোগী। বেলে দো-আঁশ, দো-আঁশ ও এটেল দো-আঁশ মাটিতে সয়াবীন চাষ করা যায়। খরিফ মৌসুমের জন্য উঁচু ও পানি নিষ্কাশনযোগ্য জমি এবং রবি মৌসুমের জন্য মাঝারি থেকে নিচু জমি নির্বাচন করতে হবে। নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, ভোলা, যশোহর, ময়মনসিংহ অঞ্চল সয়াবিন চাষের জন্য উপযোগী এলাকা
সেচ প্রয়োগঃ (১)
প্রথম সেচ বীজ বপনের ২০-২৫ দিনের মধ্যে (ফুল ধরার পূর্বে) দিতে হবে।
পরিপক্বতা ও ফসল সংগ্রহঃ
ফসল পরিপক্ব হলে শুটিসহ গাছ হলদে হয়ে আসে এবং পাতা ঝরে পড়তে শুরু করে। এ সময় গাছ কেটে ফসল সংগ্রহ করতে হবে।
খরিফ মৌসুমে বপন করলে ৮৫-৯৫ দিন এবং রবি মৌসুমে বপন করলে ফসল সংগ্রহ করতে ১১০-১২০ দিন সময় লাগে ।
ফলনঃ ১.৫ - ২.২ টন/হেক্টর ।
সেচ প্রয়োগঃ (২)
দ্বিতীয় সেচ বীজ বপনের ৫৫-৬০ দিনের মধ্যে (শুটি গঠনের সময়) দিতে হবে।
আগাছা দমন ও গাছ পাতলাকরণঃ
চারা গজানোর ২০-২৫ দিন পর আগাছা দমন করতে হবে। গাছ খুব ঘন থাকলে পাতলা করে দিতে হবে। প্রতি বর্গমিটারে রবি মৌসুমে ৫০-৬০ টি এবং খরিফ মৌসুমে ৪০-৫০ টি চারা রাখা উত্তম।
জমি তৈরিঃ
মাটির প্রকারভেদে জমিতে ৪-৫ টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ভালভাবে ঝুরঝুরে ও আগাছামুক্ত করে বীজ বপন করতে হবে ।মই দিয়ে জমি সমান করার পর সুবিধামতো আকারে প্লট তৈরি করে নিলে পরবর্তীতে জমিতে সেচ প্রয়োগ, পানি নিষ্কাশন ও অন্তরবর্তীকালীন পরিচর্যা সুবিধা হয়।
চারা গজানোর ২০-২৫ দিনের মধ্যে আগাছা দমন করতে হবে। গাছ খুব ঘন হলে পাতলা করে দিতে হবে, জাতভেদে সারিতে গাছ হতে গাছের দূরত্ব রাখতে হবে ২.৫-৪.০ ইঞ্চি। তবে প্রতি বর্গ মিটারে রবি মৌসুমে ৫০-৫৫টি এবং খরিফ মৌসুমে ৪০-৫০টি গাছ রাখা উত্তম। রবি মৌসুমে গাছে ফুল ধরা এবং ফল বা শুঁটি ধরার সময় সম্পূরক সেচের প্রয়োজন হতে পারে। বৃষ্টি না হলে প্রথম সেচ বীজ গজানোর ২০-৩০ দিন পর এবং দ্বিতীয় সেচ বীজ গজানোর ৫০-৫৫ দিন পর দিতে হবে। খরিফ মৌসুমে সাধারণত কোন সেচের প্রয়োজন হয় না, বরং জমিতে পানি জমে গেলে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
বীজ বপনের সময়ঃ
বাংলাদেশে শীত (রবি) ও বর্ষা (খরিফ) উভয় মৌসুমেই সয়াবিন বপন করা যায়। পৌষ মাসে (মধ্য ডিসেম্বর থেকে মধ্য জানুয়ারি) বপন করা উত্তম। বর্ষা মৌসুমে শ্রাবণ থেকে মধ্য-ভাদ্র পর্যন্ত (মধ্য জুলাই থেকে মধ্য আগস্ট) বপন করা উত্তম।
খরিফ মৌসুমে উল্লিখিত সময়ের আগে বপন করলে ফুল আসতে কিছুটা বিলম্ব হয় বিধায় ফসলের আয়ুকাল দীর্ঘায়িত হয়।
আন্তঃপরিচর্যা: খরিফ মৌসুমে উল্লিখিত সময়ের আগে বপন করলে ফুল আসতে কিছুটা বিলম্ব হয় বিধায় ফসলের আয়ুকাল দীর্ঘায়িত হয়।
বপন পদ্ধতিঃ
সয়াবীন বীজ সারিতে বপন করা উত্তম। তবে মাসকলাই বা মুগ ডালের মতো ছিটিয়েও বপন করা যায়। সারিতে বপন করলে সারি থেকে সারির দুরত্ব রবি মৌসুমে ৩০ সেঃমিঃ বা ১ ফুট দিতে হবে।খরিফ মৌসুমে ১ ফুট ৪ ইঞ্চি রাখতে হয়। গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ২.০-২.৪ ইঞ্চি রাখতে হয়। সারিতে ৩-৪ সেঃমিঃ গভীর করে বীজ বপন করতে হয়। ছিটিয়ে বপন করলে চাষের পর বীজ ছিটিয়ে মই দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে দিতে হবে। বপনের পূর্বে ছত্রাক বা কীটনাশক দ্বারা বীজ শোধন করে নিলে ভালো।
চারা গজানোর ২০-২৫ দিনের মধ্যে আগাছা দমন করতে হবে। গাছ খুব ঘন হলে পাতলা করে দিতে হবে, জাতভেদে সারিতে গাছ হতে গাছের দূরত্ব রাখতে হবে ২.৫-৪.০ ইঞ্চি। তবে প্রতি বর্গ মিটারে রবি মৌসুমে ৫০-৫৫টি এবং খরিফ মৌসুমে ৪০-৫০টি গাছ রাখা উত্তম। রবি মৌসুমে গাছে ফুল ধরা এবং ফল বা শুঁটি ধরার সময় সম্পূরক সেচের প্রয়োজন হতে পারে। বৃষ্টি না হলে প্রথম সেচ বীজ গজানোর ২০-৩০ দিন পর এবং দ্বিতীয় সেচ বীজ গজানোর ৫০-৫৫ দিন পর দিতে হবে। খরিফ মৌসুমে সাধারণত কোন সেচের প্রয়োজন হয় না, বরং জমিতে পানি জমে গেলে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
সার ব্যবস্থাপনাঃ
প্রতি হেক্টর সয়াবিনের জমিতে নিম্নরূপ হারে সার প্রয়োগ করতে হবে ।
| সারের নাম | সারের পরিমাণ |
|---|---|
| ইউরিয়া | ৫০-৬০ কেজি |
| টিএসপি | ১৫০-১৭৫ কেজি |
| পটাশ | ১০০-১২০ কেজি |
| জিপসাম | ৮০-১১৫ কেজি |
| বোরন (প্রয়োজনবোধে) | ৮-১০ কেজি |
সারের মাত্রা ও প্রয়োগ:
জমির উর্বরতা সব জায়গায় সমান নয়। তাই কৃষি পরিবেশ অঞ্চলভেদে সারের মাত্রা বিভিন্ন রকম হয়। সয়াবীন চাষের জন্য সাধারণভাবে অনুমোদিত সারের মাত্রা হলঃ প্রতি একর সয়াবিনের জমিতে নিম্নরূপ হারে সার প্রয়োগ করতে হবে ।
| সারের নাম | সারের পরিমাণ |
|---|---|
| ইউরিয়া অথবা জীবাণুসার | ২০-২৫ কেজি অথবা প্রতি কেজি বীজের জন্য ২৫-৩০ গ্রাম |
| টিএসপি | ৬০-৭০ কেজি |
| এমওপি | ৩৫-৪০ কেজি |
| জিপসাম | ৩৫-৪৫ কেজি |
রাসায়নিক সারসমূহের সাথে পঁচা গোবর বা কম্পোষ্ট সার প্রয়োগ করলে রাসায়নিক সার কম লাগবে। শেষ চাষের পূর্বে রাসায়নিক সার ছিটিয়ে মই দিয়ে মাটি সমান করতে হবে।
জীবাণুসার প্রয়োগ ও ব্যবহার পদ্ধতি:
সয়াবীন গাছ রাইজোবিয়াম ব্যাকটেরিয়ার সাহায্যে বাতাস থেকে নাইট্রোজেন সংগ্রহ করে গাছের শিকড়ে জমা করতে পারে। বপনের আগে বীজে জীবাণুসার মিশিয়ে বপন করলে গাছের শিকড়ে নডিউল বা গুটি সহজে সৃষ্টি হয় এবং এ নডিউল থেকে গাছ নাইট্রোজেন পায়। এক কেজি ভিজা সয়াবীন বীজের মধ্যে ২০-৩০ গ্রাম জীবাণুসার ছিটিয়ে ভালোভাবে নাড়াচাড়া করতে হবে যাতে বীজের গায়ে সমভাবে মিশে যায় বা এক কেজি বীজের মধ্যে ৬৫-৭৫ গ্রাম অণুজীব সার ছিটিয়ে দিয়ে ভালভাবে নাড়াচাড়া করতে হবে । এই বীজ সাথে সাথে বপন করতে হবে। অণুজীব সার ব্যবহার করলে সাধারণত ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হয় না। জীবাণুসার মিশানোর পর বীজ বেশি সময় রোদে ফেলে রাখলে গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। কাজেই তাড়াতাড়ি বীজ বপন করতে হবে।
সার প্রয়োগ পদ্ধতিঃ
সবটুকু সার ছিটিয়ে শেষ চাষের সময় জমিতে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
ফসল সংগ্রহ ও বীজ সংরক্ষণঃ
ফসল পরিপক্ক হলে গাছগুলো শুঁটিসহ হলুদ হয়ে আসে। এ সময় সয়াবীন গাছ মাটির উপর হতে কেটে সংগ্রহ করতে হবে। ৩-৪ দিন রোদে শুকিয়ে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে দানাগুলো আলাদা করতে হবে। মাড়াই করা বীজ রোদে ভালো করে শুকিয়ে ঠান্ডা করে গুদামজাত করতে হবে। সয়াবীনের অংকুরোদগম ক্ষমতা সাধারণ অবস্থায় বেশি দিন বজায় থাকে না। দুই থেকে তিন মাস পরই বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা কমতে শুরু করে। তাই পরবর্তী মৌসুমে লাগানোর জন্য বীজ সংরক্ষণ করতে হলে নিম্নলিখিত পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে:
১. বীজ বিশেষ যত্নসহকারে ত্রিপল বা চাটাইয়ের উপর শুকাতে হবে। ২-৩ ঘন্টা করে কয়েক দিন শুকাতে হবে। শীতকালে একটানা ৪-৫ ঘন্টা ধরে শুকালেও কোন ক্ষতি হয় না। বীজ এমনভাবে শুকাতে হবে যাতে বীজের আর্দ্রতা ৯% এর বেশি না থাকে।
২. শুকানো বীজ ভালোভাবে ঝেড়ে পরিষ্কার করতে হবে এবং রোগাক্রান্ত পঁচা বীজ বেছে ফেলে দিতে হবে।
৩. পলিথিনের ব্যাগ, টিনের ড্রাম, আলকাতরা মাখা মাটির মটকা বা কলসীতে বীজ সংরক্ষণ করে মুখ ভালোভাবে আটকিয়ে রাখতে হবে যেন কোনভাবেই ভিতরে বাতাস ঢুকতে না পারে। বীজ শুকানোর পর গরম অবস্থায় সংরক্ষণ না করে ঠান্ডাা হলে সংরক্ষণ করতে হবে।
৪. বীজের পাত্র অবশ্যই ঠান্ডা অথচ শুষ্ক জায়গায় রাখতে হবে। সরাসসি মেঝেতে না রেখে মাচা বা কাঠের তক্তার উপর রাখলে ভালো হয়।
৫. মাঝে মধ্যে বীজের আর্দ্রতার দিকে নজর রাখতে হবে। বীজের আর্দ্রতা বেড়ে গেলে প্রয়োজন মতো রোদে শুকিয়ে পূর্বের ন্যায় একই নিয়মে পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে।
