পেয়ারা চাষাবাদ পদ্ধতি
বাংলাদেশের বিভিন্ন ফল মূলের মধ্যে পেয়ারা অন্যতম । দেশের সব জায়গাতেই কম বেশি পেয়ারা জন্মে । তবে বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, চট্টগ্রাম, ঢাকা, গাজীপুর, কুমিল্লা, মৌলভীবাজার, খাগড়াছড়ি এবং রাঙামাটি এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে পেয়ারার চাষ হয় । বিভিন্ন জাতের দেশি পেয়ারা চাষের পাশাপাশি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত বিভিন্ন উন্নত জাতের পেয়ারার চাষও এখন দেশের অনেক জায়গায় হচ্ছে । এগুলোর মধ্যে স্বরূপকাঠি, কাঞ্চননগর ও মুকুন্দপুরী উল্লেখযোগ্য । বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট উদ্ভাবিত দুটি উন্নত জাত হল কাজী পেয়ারা ও বারি পেয়ারা – ২ ।
জলবায়ু ও মাটিঃ
পেয়ারা উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুর ফল। প্রায় সবরকম মাটিতেই চাষ করা যায় তবে জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ দোআঁশ মাটি থেকে ভারী এঁটেল মাটি যেখানে পানি নিষ্কাশনের বিশেষ সুবিধা আছে সেখানে ভাল জন্মে । ৪.৫ – ৮.২ অম্লক্ষারত্বের মাটিতে এটা সহজে জন্মে ।
বংশ বিস্তারঃ
বীজ দ্বারা বংশবিস্তার সবচেয়ে সহজ, এবং মাতৃগুণাগুণ প্রায় হুবহু বজায় থাকে। বীজ উৎপাদনের জন্য অঙ্গজ পদ্ধতিতে বংশবিস্তারই উত্তম । অঙ্গজ পদ্ধতির মধ্যে গুটি কলমই বহুল পরিচিত ।
গর্তের আকারঃ
ফিতা দ্বারা ২ ফুট × ২ ফুট × ১.৫ ফুট আকারের জায়গা মেপে নিয়ে গর্ত তৈরী করতে হবে ।
গর্ত থেকে গর্তের দূরত্বঃ
৪ থেকে ৬ মিটার পর্যন্ত হতে পারে।
গর্তে সারের পরিমাণঃ
১০-১৫ কেজি পচা গোবর/কম্পোস্ট, ২৫০ গ্রাম টিএসপি এবং ২৫০ গ্রাম পটাশ সার গর্তের মাটির সাথে মিশাতে হবে। এভাবে সার প্রয়োগের পর গর্ত ভরাট করে ১০-১৫ দিন রেখে দিতে হবে।
চারা/কলম রোপণঃ
মে (বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ) থেকে সেপ্টেম্বর (ভাদ্র-আশ্বিন) মাস উপযুক্ত সময়। তবে পানি সেচের ব্যবস্থা থাকলে সারাবছরই লাগানো যায়। গর্ত ভরাটের ১০-১৫ দিন পর চারা/কলম রোপণের পূর্বে মাটি উলটপালট করে গর্তে চারাটি সোজাভাবে স্থাপন করতে হবে। তারপর চারার গোড়ার মাটি হালকাভাবে চাপ দিয়ে শক্ত করে দিতে হবে।
খুঁটি দেয়া ও পানি সেচঃ
চারা লাগানোর পর একটি খুটি দিয়ে বেঁধে দিতে হবে এবং প্রয়োজনে পানি দিতে হবে।
পেয়ারা চাষে সার ব্যবস্থাপনা:
প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি (ফাল্গুন) , মে (বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ) ও সেপ্টেম্বর (ভাদ্র-আশ্বিন) মাসে তিন কিস্তিতে সার প্রয়োগ করতে হবে। সার একবারে গোঁড়ায় না দিয়ে যতদূর পর্যন্ত ডালপালা বিস্তার করেছে সে পর্যন্ত মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। নিচের ছকে বিভিন্ন বয়সের গাছ প্রতি সারের পরিমাণ উল্লেখ করা হলো-
সারের নাম
| গাছের বয়স | ||
| ১-২ বছর | ৩-৫ বছর | ৬ বছর বা ৬ এর বেশী | |
| পচা গোবর সার (কেজি) | ১০-১৫ | ২০-৩০ | ৪০ |
| ইউরিয়া (গ্রাম) | ১৫০-২০০ | ২৫০- ৪০০ | ৫০০ |
| টিএসপি (গ্রাম) | ১৫০-২০০ | ২৫০-৪০০ | ৫০০ |
| এমওপি/পটাশ (গ্রাম) | ১৫০-২০০ | ২৫০-৪০০ |
৫০০
|
সার প্রয়োগ পদ্ধতিঃ
গাছে সার প্রয়োগের পর এবং খরার সময় বিশেষ করে ফলের গুটি আসার সময় পানি সেচ দিতে হবে। তাছাড়া গোড়ার আগাছা পরিষ্কার ও মাটি ঢেলা ভেঙ্গে দিতে হবে ।
সেচ ব্যবস্থাপনাঃ
চারা রোপণের সময় মাটি শুকনো থাকলে মাঝে মাঝে কিছু পানি দিতে হবে। বৃদ্ধির প্রাথমিক পর্যায়ে বছরে ৮-১০ বার পানি সেচের প্রয়োজন হয়। ফলন্ত গাছে শুষ্ক মৌসুমে (ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত) ১০-১৫ দিন পর পর পানি সেচের ব্যবস্থা করলে ফল ঝরা হ্রাস পাবে। ফল বড় হবে ও ফলন বাড়বে। তবে গোড়ায় পানি জমলে গাছ মারা যেতে পারে। তাই দ্রুত পানি নিষ্কাশন জরুরী।
অঙ্গ ছাঁটাইঃ
মরা, রোগাক্রান্ত ও অপ্রয়োজনীয় ডালপাল ছাঁটাই করতে হবে। রোপণকৃত চারা বা কলমের সুন্দর কাঠামো দেওয়ার নিমিত্তে মাটি থেকে ১-১.৫ মিটার উপরে বিভিন্ন দিকে ছড়ানো ৪-৫ টি ডাল রেখে নিচের দিকের বাকী সকল ডালপালা কেটে দিতে হবে। বয়স্ক গাছে ফল সংগ্রহের পর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে অঙ্গ ছাঁটাই করতে হবে। এতে করে নতুন ডালপালা গজাবে ও বেশী ফল ধরবে ।
ডাল নুয়ে দেয়াঃ
পেয়ারার খাড়া ডালে নতুন শাখা ও ফল কম হয়। এজন্য পেয়ারা গাছে ডালপালা সুতলী দ্বারা বেঁধে নুয়ে দিলে প্রচুর নতুন শাখা গজায়। এতে ফলন ও গুনগতমান বৃদ্ধি পায়।
ফল ছাঁটাইকরণঃ
কাজী পেয়ারা ও বারি পেয়ারা-২ এর গাছে প্রচুর পরিমাণে ফল আসে। ফল আকারে বড় হওয়ায় গাছের পক্ষে ভার বহন করা সম্ভব হয়ে উঠে না। তখন ফলের ভারে ডালপালা ভেঙ্গে যায়, ফল ছোট হয় ও গুনগত মান কমে যায়। এজন্য গাছকে দীর্ঘদিন ফলবান রাখতে ও গুনগতমাণ বজায় রাখতে ফলের মার্বেল অবস্থায় ৫০-৬০% ফল ছাঁটাইকরণ দরকার । কলমের গাছে প্রথম বছর থেকে ফল আসতে থাকে । কিন্তু ১ম বছরে ফল না রাখাই ভাল । দ্বিতীয় বছরে অল্প সংখ্যক ফল রাখা যেতে পারে। এভাবে পর্যায়ক্রমে গাছের অবস্থা বিবেচনা করে ফল রাখা যেতে পারে। পরিকল্পিতভাবে ফুল-ফল ছাঁটাই করে কাজী পেয়ারা ও বারি পেয়ারা ২ হতে সারাবছর ফল পাওয়া যেতে পারে।
ফল ঢেকে দেয়া (ব্যাগিং):
পেয়ারা ছোট অবস্থায় ব্যাগিং করলে রোগ, পোকা, পাখি, বাদুর ও কাঠবিড়ালী থেকে রেহাই পাওয়া যায় । ব্যাগিং করা ফলে সূর্যের আলট্রাভায়োলেট রশ্মি লাগে না বিধায় কোষ বিভাজন বেশী হয়, অপেক্ষাকৃত বড় ও আকর্ষণীয় হয়। ছোট ছিদ্রযুক্ত পলিথিন অথবা বাদামী কাগজ দিয়ে ব্যাগিং করা যেতে পারে। ব্যাগিং করার পূর্বে প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে টিল্ট ২৫০ ইসি মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
পেয়ারা সংগ্রহ ও পরবর্তী ব্যবস্থাপনা:
গ্রীষ্মের শেষ থেকে বর্ষার শেষ পর্যন্ত এবং শীতকালে পেয়ারা পাওয়া যায়। পুষ্ট বা ডাসা ফল সাবধানে পাড়তে হবে। পাকা পেয়ারার রং হালকা সবুজ বা হালকা হলুদ হয়। পেয়ারা কোন অবস্থাতেই বেশী পাকতে দেয়া উচিৎ নয়, এতে স্বাদ কমে যায়। উঁচু ডাল থেকে বাশেঁর মাথায় ও তলে আকশি লাগিয়ে পেয়ারা পাড়তে হয়। পরিপক্ব পেয়ারা বোঁটা বা দু-একটি পাতাসহ কাটলে বেশীদিন সতেজ থাকে এবং বাজারে দাম বেশী পাওয়া যায়। প্রখর রোদ ও বৃষ্টির সময় পেয়ারা পাড়া উচিৎ নয়। প্রতিটি পেয়ারা গাছ প্রথম দিকে ৪০০ থেকে ৫০০ টি ফল উৎপন্ন করে। তারপর ৮-১০ বছর পর ৯০০-১০০০ টি ফল উৎপন্ন করে । পেয়ারা ফল ৮-১৪ ডিগ্রী সে. তাপমাত্রায় ৪ সপ্তাহ পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায় ।
