ধানের ব্লাস্ট রোগ ও তার প্রতিকার | ধানের রোগ ও বালাই

 ধানের ব্লাস্ট (Blast) রােগের লক্ষণ ও করণীয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা 


ধানের ব্লাস্ট (Blast) একটি মারাত্মক ছত্রাকজনিত রােগ। ধান গাছের ৩টি অংশে রােগটি আক্রমণ করে থাকে।গাছের আক্রান্ত অংশের ওপর ভিত্তি করে এ তিনটি রোগ নামে পরিচিত।আক্রান্ত রােগের নামগুলাে হলাে-

১. পাতা ব্লাস্ট

২. গিট ব্লাস্ট

৩. নেক/শীষ ব্লাস্ট


ব্লাস্ট রােগের কারণ

১.পাইরিকুলারিয়া গ্রিসিয়া (Pyricularia grisea)
নামক ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে।

২.হালকা মাটি বা বেলেমাটি যার পানি ধারণক্ষমতা
কম সেখানে রােগ বেশি হতে দেখা যায়।

৩.জমিতে মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া সার এবং
প্রয়ােজনের তুলনায় কম পটাশ সার দিলে এ রােগের
আক্রমণ বেশি হয়।

৪.দীর্ঘদিন জমি শুকনা অবস্থায় থাকলেও এ
রােগের আক্রমণ হতে পারে।

৫.রাতে ঠান্ডা, দিনে গরম এবং শিশির থাকলে এ রােগের প্রকোপ বেড়ে যায়।

৬.রোগপ্রবণ জাতে রোগ সংক্রমণ হলে শতকরা ৮০ ভাগ ক্ষতি হয়ে থাকে।



ব্লাস্ট রোগের ছত্রাক জীবাণু 

পাইরিকুলারিয়া ওরাইজি (Pyriculria orayzai) নামক একধরণের ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে।এই ছত্রাক জীবাণু ধান গাছের যে কোন অবস্থায় আক্রমণ করতে পারে।রোগাক্রান্ত বীজ ও আশেপাশের আক্রান্ত গাছ থেকেও এ রোগের জীবাণু এসে থাকে।



ব্লাস্ট রোগ আক্রমণের মৌসুম/সময়

এ রোগটি বোরো ও আমন উভয় মৌসুমে বেশী হয় এবং ধানের চারা অবস্থা থেকে ধান পাকার আগ পর্যন্ত যে কোন সময় এ রোগ দেখা যায়।


ব্লাস্ট রোগ যেভাবে ছড়ায়

√√রোগাক্রান্ত গাছের জীবাণু বীজ, বাতাস, কীটপতঙ্গ বা পোকা ও আবহাওয়ার মাধ্যমে এক জমি থেকে অন্য জমিতে ছড়িয়ে পড়ে।

√√ধানের ব্লাস্ট রোগ বীজের মাধ্যেমে এক মৌসুম হতে অন্য মৌসুমে ছড়ায়।

√√রাতে ঠাণ্ডা, দিনে গরম ও সকালে পাতলা শিশির
জমা হলে এ রােগ দ্রুত ছড়ায়।

√√অধিক মাত্রায় নাইট্রোজেন সার এবং বাতাসের আর্দ্রতা এ রোগের প্রকোপ বাড়ায়।



ব্লাস্ট রোগের অনুকূল পরিবেশঃ 

রাতে ঠাণ্ডা (২০-২২°সে.) দিনে গরম (২৫-২৮°সে.) ও সকালে পাতলা শিশির জমা হলে এ রোগ দ্রুত ছড়ায়। হালকা মাটি বা বেলেমাটি যার পানি ধারণক্ষমতা কম সেখানে রোগ বেশি হতে দেখা যায়। জমিতে মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া সার এবং প্রয়োজনের তুলনায় কম পটাশ সার দিলে এ রোগের আক্রমণ বেশি হয়। দীর্ঘদিন জমি শুকনা অবস্থায় থাকলেও এ রোগের আক্রমণ হতে পারে। রোগাক্রান্ত বীজ ব্যবহার ও রোগ প্রবণ জাতের ধান চাষ করলে।জমিতে বা জমির আশেপাশে অন্যান্য  পোষক গাছ বা আগাছা থাকলে।



পাতা ব্লাস্টের লক্ষণ

➡️আক্রান্ত পাতায় প্রথমে ডিম্বাকৃতির ছােট ছােট ধূসর বা
সাদা  ছাঁই বর্ণের দাগ দেখা যায়। দাগগুলাের চারদিক
গাঢ় বাদামি বর্ণের হয়ে থাকে।

➡️এ দাগ ধীরে ধীরে বড় হয়ে চোখের আকৃতি ধারণ
করে। অনেক দাগ একত্রে মিশে পুরাে পাতাটাই মেরে
ফেলতে পারে।বড় দাগগুলাের (১.০-১.৫Xo.৩-০.৫ সেন্টিমিটার) কেন্দ্র ভাগ ধূসর বর্ণের হয়।

➡️এ রােগে ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হলে জমিতে মাঝে
মাঝে পুড়ে যাওয়ার মতাে মনে হয়।

➡️অনেক ক্ষেত্রে খােল ও পাতার সংযােগস্থলে কাল
দাগের সৃষ্টি হয়। যা পরবর্তীতে পচে যায় এবং পাতা
ভেঙে পড়ে ফলন বিনষ্ট হয়।

➡️শেষ পর্যন্ত পুরো পাতা, এমনকি পুরো গাছটিই মারা যেতে পারে।



গিঁট বা নােড ব্লাস্ট

➡️ধান গাছের থােড় বের হওয়ার পর থেকে এ রােগ
দেখা যায়। 

➡️গিঁটে কালাে রঙের দাগ সৃষ্টি হয়। ধীরে
ধীরে এ দাগ বেড়ে গিঁট পচে যায়, ফলে ধান গাছ গিঁট
বরাবর ভেঙে পড়ে।

➡️জোরে বাতাস প্রবাহিত হলে আক্রান্ত স্থান ভেঙ্গে পড়ে যায় কিন্তু একদম আলাদা হয়ে যায় না। এ অবস্থায় আক্রান্ত গিঁটের উপরের অংশ মারা যায়।



নেক বা শীষ ব্লাস্ট

➡️শীষের গোড়া আক্রান্ত হলে সেখানে বাদামী দাগ পড়ে। শীষের গোড়া বা যেকোন শাখা বা ধান আক্রান্ত হতে পারে।

 ➡️শীষের গোড়ায় আক্রমণ হলে সে অংশ  পচে যায় এবং শীষ ভেঙে পড়ে।

➡️ধান পুষ্ট হওয়ার আগে এ রোগের আক্রমণ হলে সব ধান চিটা হয়।



ব্লাস্ট রােগের প্রতিরােধ ব্যবস্থা

১.রােগ প্রতিরােধী জাত ব্যবহার করতে হবে।

২.মাটিতে জৈব সারসহ সুষম মাত্রায় সব ধরনের
সার ব্যবহার করতে হবে।

৩.আক্রান্ত জমির খড়কুটা পুড়িয়ে ফেলতে হবে
এবং ছাই জমিতে মিশিয়ে দিতে হবে।

৪.সুস্থ গাছ হতে বীজ সংগ্রহ করতে হবে, দাগি বা
অপুষ্ট বীজ বেছে ফেলে দিয়ে সুস্থ বীজ ব্যবহার
করতে হবে।



সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (Integrated pest management)


♠জমির মাটিতে জৈব সার ব্যবহার এবং সুষম মাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহার করা।

♠ রােগমুক্ত জমি থেকে বীজ সংগ্রহ করা।

♠সুষম মাত্রায় ইউরিয়া সার প্রয়ােগ করা।

♠ জমিতে সব সময় পানি রাখা।

♠রােগের প্রাথমিক অবস্থায় বিঘা প্রতি ৫ কেজি হারে পটাশ সার উপরি প্রয়ােগ করা।

♠ জমিতে ব্লাস্ট রােগ দেখামাত্র পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা।

♠ সকল সুগন্ধি ধান, হাইব্রিড ধান, লবণ সহনশীল ধান, এবং ব্রি ধান-২৮, ব্রি ধান-২৯,ব্রি ধান-৬৩, ব্রি ধান-৬৪ ধানের ফুল আসার সময় নিন্মচাপ দেখা দিলে ছত্রাক নাশক আগাম স্প্রে করা।


♠সুস্থ বীজ ব্যবহার এবং ব্লাস্ট প্রতিরােধক জাতের ধান, যেমন- 

বোরো মৌসুমেঃ

 বিআর ৩, বিআর ৬, বিআর ৭, বিআর ১২, বিআর ১৪, বিআর ১৬, বিআর১৭, ব্রি ধান ২৮, ও ব্রি ধান ৪৫। 


আউশ মৌসুমেঃ 

বিআর ৩, বিআর৬, বিআর ৭, বিআর ১২, বিআর ১৪, বিআর ১৬, বিআর ২০, বিআর ২১ ও বিআর ২৪ এবং 


আমন মৌসুমেঃ 

বিআর ৪, বিআর ৫, বিআর ১০, ব্রি ধান ৩২, ব্রি ধান ৩৩, ও ব্রি ধান ৪৪ চাষ করা।রোগ হওয়ার পরে করণীয়। 



ভেষজ পদ্ধতিতে দমন (Suppression of herbal methods)

★ পেঁপে পাতা দ্বারা দমনঃ

এক কেজি পরিমাণ পেঁপে পাতা পিষে ১০ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম ডিটারজেন্ট পাউডার একসাথে মিশ্রণ করে মিশ্রণটি  চেকে ৫ শতক জায়গায় প্রয়ােগ করা।


★ জবা ফুলের পাতা দ্বারা দমনঃ

এক কেজি পরিমাণ জবা ফুলের পাতা পিষে ১০ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম ডিটারজেন্ট পাউডার সহ একত্রে মিশ্রণ করে মিশ্রণটি চেকে ৫ শতক জায়গায় প্রয়ােগ করা।


ব্লাস্ট রোগ হলে করণীয়

১.রােগের আক্রমণ হলে জমিতে ইউরিয়া সারের
উপরিপ্রয়ােগ বন্ধ রাখতে হবে।

২.জমিতে সব সময় পানি রাখতে হবে।

৩.রােগের শুরুতে বিঘাপ্রতি ৫ কেজি পটাশ সার
উপরিপ্রয়ােগ করতে হবে।

৪. ট্রাইসাইক্লাজল (ডুপার ৭৫ ডব্লিউপি) বা
টেবুকোনাজল + ট্রাইফ্লক্সিস্ট্রবিন (নাটিভাে ৭৫
ডব্লিউপি) প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে
মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে
হবে।


সুপারিশকৃত বালাইনাশকঃ


বালাইনাশকের নাম গ্রুপ প্রয়ােগ মাত্রা কোম্পানী
ফিলিয়া ৫২৫ এসই প্রােপিকোনাজল (১২.৫%) + ট্রাইসাক্লাজোল (৪০%) ১৩৩ মিঃলিঃ/বিঘা সিনজেনটা বাংলাদেশ লিমিটেড
এমিস্টার টপ এজোক্সিন্ট্রোবিন (২০%) + ডাইফেনােকোনাজল (১২.৫%) ১০০ মিঃলিঃ/বিঘা সিনজেনটা বাংলাদেশ লিমিটেড
নাটিভাে ৭৫ ডব্লিউপি টেবুকোনাজল (৫০%)+ ট্রাইফ্লোক্সিন্ট্রোবিন(২৫%)                            ৪০ গ্রাম/বিঘা বায়ার ক্রপসায়েন্স লিমিটেড
ট্রুপার ৭৫ ডব্লিউপি ট্রাইসাইক্লাজোল ৫৫ গ্রাম/বিঘা অটো ক্রপ কেয়ার লিমিটেড
হেকোনাজল ৫ইসি হেক্সাকোনাজল ৬৭ মিঃলিঃ/বিঘা হেকেম(বাংলাদেশ) লিমিটেড
জিল ৭৫ ডব্লিউপি ট্রাইসাইক্লাজোল ৫৫ গ্রাম/বিঘা মেপ এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড
এল সাইক্লাজোল ৭৫ ডব্লিউপি ট্রাইসাইক্লাজোল ৫৫ গ্রাম/বিঘা দি লিমিট এগ্রোপ্রােডাক্টস লিমিটেড
সায়ানােজল ৭৫ ডব্লিউপি ট্রাইসাইক্লাজোল ৫৫ গ্রাম/বিঘা সিরাজ এগ্রো ইন্টারন্যাশনাল
দিফা ৭৫ ডব্লিউপি ট্রাইসাইক্লাজোল ৫৫ গ্রাম/বিঘা ইনতেফা
এডিফেন ৫০ ইসি এডিফেনফস ১১৪ মিঃলিঃ/বিঘা সেতু পেস্টিসাইডস লিমিটেড


রোগের প্রাথমিক অবস্থায় বিঘা প্রতি (৩৩ শতকে) ৫ কেজি পটাশ সার উপরি প্রয়োগ করা । তাছাড়া ছত্রাকনাশক  প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে
মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে
হবে।



##আক্রান্ত ক্ষেত থেকে বীজ সংগ্রহ করবেন না।পরবর্তীতে যা যা করবেন


♥ধান কাটার পর শুকিয়ে নিয়ে নাড়া জমিতেই পুড়িয়ে ফেলুন।

♥মাটি পরীক্ষা করে জমিতে সুষম সার প্রয়ােগ করুন

♥ মাটিতে জৈব সার প্রয়ােগ করুন।

♥এ রােগের আশঙ্কা থাকলে জমিতে পটাশ সার দুইবারে প্রয়ােগ করুন (জমি তৈরির সময় অর্ধেক ও চারা লাগানাের ৩০ দিন উইরিয়া উপরি প্রয়ােগের সময় অর্ধেক)।


✳️♦ যোগাযোগঃ

কৃষি বিষয়ক যে কোন সমস্যার সমাধান ও ফসলের রােগবালাই এবং পােকামাকড় দমনে সঠিক পরামর্শ দিতে আপনার পাশে রয়েছে ekrishi24.অথবা নিকটস্থ “কৃষক তথ্য ও পরামর্শ কেন্দ্র (ফিয়াক)” অথবা “উপ সহকারী কৃষি অফিসার” এর সাথে যোগাযোগ করুন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url