দুশ্চিন্তা/মানসিক চাপ থেকে মুক্তির ১১টি উপায়
দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা
টেনশন বা দুশ্চিন্তা অথবা মানসিক চাপ মানুষের জীবনের সঙ্গেই জড়িত।আসলে এটি যেন
মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। টেনশন ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন ব্যাপার!
বিভিন্ন গবেষণার ফলে প্রমাণিত হয় যে, মানসিক চাপ হৃদযন্ত্রের ক্ষতি সাধন করে।
নিউ ইয়র্কের রচেস্টার মেডিকল সেন্টারের ‘সেন্টার ফর মাইন্ড-বিডি রিসার্চ’ এর
মনোরোগবিদ্যার সহকারী অধ্যাপক ড. ক্যাথি হেফনার বলেন, “বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত
বিশ্লেষণ করে জানা গেছে দুশ্চিন্তা, স্বল্পপুষ্টির খাবার খাওয়া অথবা ব্যায়াম
করার অনীহার ফলে যেসব শারীরিক সমস্যা দেখা যায়, মানসিক চাপের ফলেও সেইসব
সমস্যাগুলো সাধারণত আরও ভয়াবহ হয়।”
|
|
| দুশ্চিন্তা/মানসিক চাপ থেকে মুক্তির ১১টি উপায় |
দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকার উপায় নিয়ে সাজানো হলো লেখাটি; যে
উপায়গুলো মানসিক চাপ কমিয়ে হৃদয়ও সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে।
১। মেডিটেশন
মানসিক চাপ দূর করে মনকে শান্ত রাখার জন্য মেডিটেশন একটি কার্যকরী
ব্যায়াম। কার্নেগী মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ২৫ মিনিট
ধরে টানা ৩ দিন মেডিটেশন করলে তা হতাশা এবং দুশ্চিন্তা অনেকটাই দূর করতে
সহায়তা করে। “ইয়োগা বা ধ্যান শরীরে সকল দুশ্চিন্তা সৃষ্টিকারী হরমোনের পরিমাণ
কমিয়ে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।”
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত ইয়োগা করেন তারাই তুলনামূলক কম শারীরিক সমস্যা
বা প্রদাহে ভোগেন।
২। নিজেকে ব্যস্ত রাখুন
দুশ্চিন্তাকে মাথা থেকে দূরে রাখতে হলে সবসময় নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। আপনার
মস্তিষ্ক এবং হাত ব্যস্ত থাকে এমন যে কোন কাজ করুন যেমন গেম খেলুন বা কোন
হস্তশিল্প তৈরি করুন। কথায় আছে, “অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।” এটি কিন্তু
বাস্তবিকই সত্য। আপনি কোনো কাজ না করে অলসভাবে শুয়ে বসে থাকলে হতাশা আর
দুশ্চিন্তা আপনাকে ঘিরে ধরবে- এটাই স্বাভাবিক। তাই যে কোনো প্রোডাক্টিভ কাজে
নিজেকে সবসময় ব্যস্ত রাখুন।
৩। ক্ষোভ ঝেড়ে ফেলুন
মনের মধ্যে ক্ষোভ জমা করে রাখার অভ্যাসটা কখনোই হৃদযন্ত্রের জন্য মঙ্গল বয়ে আনে
না। নিউরোসায়েন্সের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ক্ষমা করার পরিবর্তে ক্ষোভ জমা করে
রাখলেই বরং মানসিক চাপ বেড়ে যায় এবং সেই সঙ্গে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার হার আরও
বাড়ে।
ডক্টর সিমন্স বলেছেন, “আপনি ভাবতেই পারবেন না মনের মধ্যে ক্ষোভ জমা থাকলে তা কত
দ্রুত এবং দীর্ঘ সময় ধরে শরীরের ক্ষতি সাধন করে। তাই নিজের ঘাড় থেকে এই আপদকে
নামিয়ে মানসিকভাবে সুস্থ থাকুন সব সময়।”
৪। বাস্তববাদী হওয়া
যে কোনো ঘটনা বা ভবিষ্যতে কী ঘটতে পারে এ আশঙ্কায় অনেকেই অযথা উৎকণ্ঠিত ও
চিন্তিত হয়ে পড়েন। এক্ষেত্রেই মনে রাখতে হবে, জীবন মানেই কিছু সমস্যা থাকবে এবং
এমন কিছু ঘটনা ঘটতে পারে যা জীবনে কখনো কাম্য নয়। তবে এটাও ঠিক, সবকিছুর সমাধান
রয়েছে ও সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যায়। কাজেই বাস্তব পরিস্থিতি মেনে নিয়ে তার
সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার মন-মানসিকতা গ্রহণ করতে হবে। ফলে কিছুটা টেনশন কমে যাবে।
তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারের প্রতি অতিরিক্ত আবেগী মনোভাব দূর করতেই হবে।
উদাহরণস্বরূপ, গবেষকদের মতে প্রিয় ফুটবল বা ক্রিকেট দলের পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে
হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার হারও বেড়ে যায়।
তাই তুচ্ছ বা যেকোন কারণে উত্তেজিত হওয়া যাবে না। কারণ জীবনের মূল্য এর চেয়ে
ঢের বেশি।
৫। নির্ভুল হওয়ার চিন্তা বাদ দিন
যারা সাধারনণত টাইপ ‘এ’ এর চরিত্রের মানে সবসময় শুদ্ধ চরিত্রের অধিকারী হতে চান
তারাই মূলত হৃদরোগে বেশির ভাগ ভোগেন।
অধ্যাপক হেফনারের মতে, এই ধরনের অতিরিক্ত খুঁতখুঁতে মনোভাব শেষ পর্যন্তই
ব্যক্তিচরিত্রে শত্রুতার মনোভাব তৈরি করে। তিনি বলেন, টাইপ ‘এ’ চরিত্রের পেছনে
প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা শত্রুভাবাপন্ন মনোভাবই মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে।
প্রকৃতপক্ষে, এ ধরনের মনোভাবই ব্যক্তিমনে অন্যদের প্রতি প্রবল বিদ্বেষ তৈরি করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি হওয়ার জন্যই মূল
কারণ যা পরে হৃদরোগ ডেকে আনে। তাই সবসময় ভালো চিন্তা করে সবার সঙ্গে ভালো
ব্যবহার করুন।
৬। ক্যাফেইন নেওয়া কমিয়ে দিন
ক্যাফেইন খুব দ্রুতই আপনার ইন্দ্রিয়কে সজাগ করে তুলে এবং মানসিক চাপ বর্ধক
হরমোনের পরিমাণই বাড়িয়ে দিতে পারে। এটা তখনই ভালো যদি আপনি কোনও হিংস্র বাঘের
মুখে পড়েন।
এজন্যই ঘন ঘন চা-কফি খাওয়ার অভ্যাস ছাড়ুন। কেননা এসবে প্রচুর পরিমাণে ক্যাফেইন
থাকে।
এমনকি জিরো-ক্যালরি বা চিনিহীন বলে যে বাজারজাত করা কোমল পানীয় থেকেও
নিজেকে দূরে রাখুন।
৭। তালিকা তৈরি করুন
আপনার মনে হতেই পারে আপনি শত শত সমস্যায় ভুগতেছেন। তাই আপনার দুশ্চিন্তার
কারণগুলোর একটা তালিকা তৈরি করে ফেলুন। দেখবেন, অল্প কয়েকটি দুশ্চিন্তার কারণ
ছাড়া আর কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না। এর মধ্যে কিছু সমস্যা থাকবেই যেগুলো কমবেশি
সবারই থাকে। আপনি সবসময় উপলব্ধি করবেন যে আপনার আসলে দুশ্চিন্তা করার খুব বেশি
কারণ নেই। এটা আপনার দুশ্চিন্তা কমাতে এবং আপনাকে মানসিকভাবে শান্তি দিবে।
সবসময় প্রাণ খুলে হাসলে শতকরা বিশভাগ বেশি ক্যালরি পোড়ানো যায়।
৮। বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটান
সবসময় একাকী থাকার মন-মানসিকতা স্বাস্থ্যের পাশাপাশি হৃদযন্ত্রেরও ক্ষতি করতে
পারে। এমনকি কখনও হৃদরোগ ধরা না পড়লেও ক্ষতির আশংকা থেকেই যায়।
এজন্যই একাকী ঘরে বসে না থেকে বন্ধুদের সঙ্গে বের হয়ে পড়ুন। তবে এক্ষেত্রে
প্রকৃত বন্ধু নির্বাচনে সচেতন হতে হবে।
৯। প্রাণ খুলে হাসুন
২০০৫ সালের পরিচালিত গবেষণায় জানা যায় যে, সবসময় গম্ভীর থাকার বদলে প্রাণ খুলে
হাসলেই শতকরা বিশভাগ বেশি ক্যালরি পোড়ানো যায়। প্রাপ্তবয়স্ক কিছু মানুষকেই
নিয়মিত হাস্যকর এবং তুলনামূলক গম্ভীর চলচ্চিত্র দেখানোর পরই গবেষকরা এই
সিদ্ধান্তে আসেন।
নিয়মিত আমোদ-প্রমোদ হৃদস্পন্দনের হার বাড়িয়েই দেয়। ২০১০ সালেই প্রকাশিত
আমেরিকান জার্নাল অফ কার্ডিওলজি’র তথ্যানুসারে, হাসি-ঠাট্টার ফলে দেহের
সংবহনতন্ত্র বা বিভিন্ন নালীর কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তাই ঠোঁটের কোণে সবসময়ই
এক চিলতে হাসি রাখুন কিংবা পারলে মন খুলে হাসতে থাকুন।
১০। ডায়েরি লিখুন
আপনি হয়তোবা কখনোই ডায়েরি লেখেননি। যে বিষয়টি আপনাকে কষ্ট দিচ্ছে, মানসিক
চাপের কারণ হচ্ছে সেটি একটি ডায়রিতে লিখে রাখুন। পাশাপাশি আপনি কী চান অথবা কী
করলে আপনার ভালো লাগবে সেই বিষয়টিও লিখুন। ডায়েরি লেখার এই অভ্যাসটিই মানসিক
চাপ কমাতে অনেকটাই সাহায্য করবে আপনাকে।
১১। পাওয়ার ন্যাপ বা পর্যাপ্ত ঘুম:
বর্তমানে বেশিরভাগ মানুষের মধ্যেই না ঘুমিয়ে থাকার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। সুস্থ
থাকতে হলে অবশ্যই ছয় থেকে আট ঘণ্টা ঘুম আবশ্যক। এক্ষেত্রে সময়ের চেয়ে কতটা
নিশ্চিন্তে (sound sleep) ঘুমানো গেলো তাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
‘ঘুম’ থেকে ভালো Stress Looser আর কিছুই হতে পারে না। তাই যখন কোনোও কিছুই আর
ভালো লাগবে না বা মনে হবে কোনো কিছুতেই মন দিতে পারছেন না, তখনই একটু নিরিবিলি
জায়গা দেখে পাওয়ার ন্যাপ নিয়ে নিন। দুশ্চিন্তা কেটে যাবে ইনশাআল্লাহ!
এ কথা যেমন সত্য যে, টেনশন মানুষের জীবনে স্বচ্ছন্দ গতি এবং স্বাভাবিক চলার পথে
বিঘ্ন ঘটায়, তেমনি এ কথাও অস্বীকার করার অবকাশই নেই যে, জীবনে কিছু পরিমাণ টেনশন
থাকা প্রয়োজন। কেননা, এই টেনশনই জীবনের কাজ করার পেছনে উৎসাহ জোগায় এবং ক্ষেত্র
বিশেষে, কাজ করার পেছনে চালিকাশক্তি হিসেবেই কাজ করে থাকে।
মুক্তির ইসলামিক উপায়
মানব জীবনে দুশ্চিন্তা আসা খুব স্বাভাবিক। এটি মানুষের জীবনের সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এতে হতাশ হলে চলবে না। এমন মানুষ পাওয়াই কঠিন, যার কোনো দুশ্চিন্তা নেই। সুখ-দুঃখ মিলিয়ে মানুষের জীবন। ইহকালীন জীবনে কষ্ট-ক্লেশ মানুষেরই সঙ্গী। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিঃসন্দেহে আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি কষ্ট-ক্লেশের মধ্যে।’ (সুরা বালাদ, আয়াত : ৪)
তাই জীবনে চলার পথে কখনো দুঃখ-দুর্দশা আসতে পারে। হতেই পারে মানসিক টেনশন। এতে হতাশ হওয়া যাবে না। বরং আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা রেখেই প্রতিটি পরিস্থিতিকে জয় করে নিতে হবে। নিছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আমল তুলে ধরা হলো, যার মাধ্যমেই দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ।
তাকদিরের ওপর বিশ্বাস
নামাজের ব্যাপারে যত্নবান হওয়া
ধৈর্য ধারণ
বেশি বেশি ইস্তেগফার
অধিক হারে দুরুদ পড়া
দোয়া করা