ধানের মাজরা পোকার লক্ষণ ও দমন ব্যবস্থাপনা | ধানের পোকা

 

 মাজরা পোকা ও তার দমন ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা 


অনেকের ধারণা কান্ডের মাইজ বা মধ্যখানে বা মধ্যে আক্রমন করে বিধায় এর নাম মাজরা পোকা রাখা হয়েছে। মাজরা পোকার আক্রমণে সাধারণতঃ ১৩ থেকে ২৬ ভাগ ফলন কম হতে পারে। ব্যাপক আক্রমণ হলে ৩০ থেকে ৭০ ভাগ পর্যন্ত ফলনের ঘাটতি হতে পারে। বাংলাদেশে ধান ফসলের জন্য ক্ষতিকর তিনটি প্রজাতির মাজরার পোকা আছে। এগুলো হলো হলুদ, কালমাথা এবং গোলাপী মাজরা পোকা । এছাড়াও সাদা প্রজাতির মাজরা ইদানিং পাওয়া যাচ্ছে। পৃথিবীব্যাপী  প্রায় ৫০ প্রকারের  মাজরা পোকা পাওয়া যায়।  তবে হলুদ মাজরা পোকা ধান ফসলের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে থাকে।


ধানের মাজরা পোকা ও তার দমন ব্যবস্থাপনা।একটি হলুদ মাজরা পোকার জীবনে প্রায় ৩০০টি পর্যন্ত ডিম দিতে পারে। মাজরা পোকার জীবন চক্র চারটি স্তরে বিভক্ত।
ধানের মাজরা পোকা 



🔰মাজরা পোকার প্রকারভেদঃ

এই পোকাগুলোর কীড়ার রঙ অনুযায়ী তাদের নামকরণ করা হয়েছে। এদের আকৃতি ও জীবন বৃত্তান্তে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও ক্ষতির ধরন এবং দমন পদ্ধতি একই রকম।বাংলাদেশে ধানের তিন ধরনের মাজরা পোকার আক্রমন দেখা যায়। 


১)হলুদ মাজরা (Scripophaga incertulus)


২)কাল মাথা মাজরা (Sesamia inferens) 


৩)গোলাপী মাজরা(Chilo polychrysus)






🔰মাজরা পোকার পরিচিতি




⏩১)হলুদ মাজরা (Scripophaga incertulus)


ধানের হলুদ মাজরা পোকা (ইংরেজি: Rice yellow stem borer)এরা Pyralidae গোত্রের এক ধরনের কীট যার বৈজ্ঞানিক নাম Scirpophaga incertulus (Walker)।


হলুদ মাজরা পোকা দেখতে হলুদ বর্ণের হলেও পাখার একেবারে নিচের দিকে একটি করে কালো বর্ণের স্পট বা দাগ থাকে।এবং পুরুষ মথের মাঝখানে ফোটা স্পষ্ট নয়। তবে পাখার পিছন দিকে ৭-৮ টা অস্পষ্ঠ ফোঁটা আছে।এছাড়া পোকার কীড়ার মাথা হলুদ বর্ণের হয়।এ পোকা পাতার ওপরের অংশে ডিম পাড়ে। এবং ডিমগুলো হলুদ বর্ণের হয়। তাছাড়া হলুদ বর্ণের আঁশ দ্বারা ঢাকা থাকে অথবা ডিমের গাদার ওপর হালকা ধূসর রঙের একটা আবরণ থাকে। আউশ, আমন ও বোরো তিন মৌসুমেই ব্যাপক আক্রমণ করে। 



⏩২)কাল মাথা মাজরা (Sesamia inferens) 


কালো মাথা মাজরা পোকা বাদামী ধূসর বর্ণের এবং  পোকার কীড়ার মাথা কালচে বর্ণের  হয়।এ পোকার ডিমের গাদার ওপর মাছের আঁশের মত একটা সাদা আবরণ থাকে, যা ডিম ফোটার আগে ধীরে ধীরে গাঢ় রং ধারণ করে।বোরো এবং আউশ মৌসুমে আক্রমণ করে।


 


⏩৩)গোলাপী মাজরা(Chilo polychrysus)


গোলাপী মাজরা পোকার ঘাড়ের মধ্যে কেশর থাকে।

এবং পোকার কীড়ার মাথা গোলাপী বর্ণের হয়ে থাকে।এছাড়া এ পোকা পাতার খোলের ভিতরের দিকে ডিম পাড়ে।গোলাপী মাজরা বোরো মৌসুমে আক্রমণ করে।





🔰মাজরা পোকার আকার আকৃতি


হলুদ মাজরা পোকার প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও স্ত্রী পোকার মধ্যে বেশ পার্থক্য বিদ্যমান। পূর্নাঙ্গ স্ত্রী পোকার গায়ের রঙ হালকা হলুদ এবং ডানার উপর দুটি পরিষ্কার কালো দাগ বা বিন্দু থাকে।


পুরুষ পোকা হালকা বাদামি রঙের। এগুলোর সামনের ডানার কিনারায় অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধূসর বর্ণের ফোঁটা দাগ থাকে। মথগুলো লম্বায় প্রায় ১৩-১৬ মিলিমিটার।





⏩ মাজরা পোকার স্বভাব


সব মাজরা পোকার মথই নিশাচর। দিনে এগুলো পাতার নিচে লুকিয়ে থাকে। কেবল রাতে অন্ধকারে এরা চলাফেরা করে। এরা সবাই আলোর দিকে আকৃষ্ট হয়।




🔰মাজরা পোকার জীবনবৃত্তান্ত


⏩ মাজরা পোকার জীবনকাল


হলুদ মাজরা পোকার জীবনকাল প্রায় ৪০ থেকে ৬০ দিন। তাপমাত্রা ও বাতাসের আদ্রর্তার উপর নির্ভর করে ৪৭ থেকে ৮৬ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। এক বছরে এরা প্রায় ৫ থেকে ৬ বার বংশবিস্তার করে থাকে। মাজরা পোকার ডিম ফুটে কীড়া হতে প্রায় ৬ থেকে ৮ দিন সময় লাগে। কীড়া অবস্থায় এরা প্রায় ২৪ থেকে ৩২ দিন পর্যন্ত সময় নেয়। সময়ে সময়ে আবার প্রায় ২৮ থেকে ৫৬ দিন পর্যন্তও কীড়া বা লার্ভা অবস্থায় থাকতে পারে।  পরবর্তীতে পুত্তলীতে রুপান্তরিত হয়। পুত্তলিগুলো গাছের গোড়ার দিকে অবস্থান করে। প্রায় ৬ থেকে ১২ দিন পুত্তলী অবস্থায় থেকে এরা পূর্ণাঙ্গ পোকায় রুপান্তরিত হয়। পূর্ণাঙ্গ পোকা ৭ থেকে ১০ দিন বেঁচে থাকে।



🔰মাজরা পোকার জীবন চক্রঃ


একটি হলুদ মাজরা পোকার জীবনে প্রায় ৩০০টি পর্যন্ত ডিম দিতে পারে। মাজরা পোকার জীবন চক্র চারটি স্তরে বিভক্ত। 


যথাঃ  ১)ডিম   ২)কীড়া বা লার্ভা    ৩)পুত্তলী বা পিউপা এবং    ৪)পূর্ণাঙ্গ পোকা। 




⏩ ডিম


পূর্নবয়স্ক স্ত্রী ও পুরুষ মথ সাধারনত সন্ধ্যার পর থেকে সক্রিয় হয়ে ওঠে। উভয় মথেল যৌনমিলন ঘটে কেবল রাতে। মিলনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্ত্রী মথ ডিম পাড়তে শুরু করে। একটি স্ত্রী মথ ধানের পাতার উপরে ৩-৭ টি গুচ্ছে ডিম পাড়ে। প্রতিটি গুচ্ছে ৫০-৮০ টি ডিম থাকে। গুচ্ছগুলো হালকা ধূসর রঙের লোম দিয়ে ঢাকা থাকে। একটি স্ত্রী পোকা সর্বমোট ১০০-৩০০ টি ডিম পাড়তে পারে।




⏩ লার্ভা দশা


ডিম পাড়ার ৭-১০ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে কীড়া বা শূককীট বের হয়। এগুলোকে শুয়াপোকা বলে। এ সময় এরা পাতার বহিঃত্বক খেয়ে জীবনধারন করে। এক ধরনের সুতার সাহায্যে ঝুলে এরা এক গাছ থেকে অন্য গাছে যায়। অতঃপর পাতার খাপের মধ্যে প্রবেশ করে। এগুলো ২-৩ দিন পর কান্ড ছিদ্র করে ভেতরে ঢুকে যায় এবং পরিনত মথ হয়ে বাইরে আসার পূর্ব পর্যন্ত সেখানেই থাকে। অনুকূল আবহাওয়ায় শতকরা ৭৫ ভাগ শূককীট কান্ডের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে। এগুলোর মধ্যে মাত্র ১০% শূককীট মথ হতে পারে।





⏩ পিউপা দশা


কান্ডের ভেতরে এরা ৬ বার খোলস বদলায়। প্রতিবার সময় লাগে ৪-৬ দিন। এভাবে শূককীট থেকে মূককীট হতে সময় লাগে ৩-৬ সপ্তাহ। মূককীট রেশমি সূতা দিয়ে তৈরি কোকুন এর মধ্যে থাকে। এটি দেখতে সাদাটে-হলুদ অথবা খয়েরি রঙের এবং লম্বায় প্রায় ১৬ মিলিমিটার। পূর্নাঙ্গ মূককীট কান্ডের নিচের দিকে থাকে বলে ধান কাটার পর নাড়ার মধ্যে এগুলোকে পাওয়ায় যায়।





⏩ পূর্নাঙ্গ দশা প্রাণী


অনুকূল আবহাওয়ায় মূককীট অবস্থায় ৬-১০ দিন কাটাবার পর তা থেকে পূর্ণ মথ বেরিয়ে আসে। আবহাওয়ার অবস্থাভেদে হলুদ মাজরার জীবনচক্র সম্পন্ন হতে সময় লাগে ৫২-৭১ দিন। প্রাপ্তবয়স্ক মথ ৪-৫ দিন বেঁচে থাকে। এরা প্রায় ৫-১০ মাইল পর্যন্ত উড়তে পারে। বছরে এগুলোর অন্ততঃ পাঁচটি জীবনচক্র বা জেনারেশন সম্পন্ন হয়।





🔰মাজরা পোকার ক্ষতির ধরণঃ


মাজরা পোকা দুই ধরনের ক্ষতি করে থাকে।

১)  Dead Heart (মরা ডিগ বা ডেডহার্ট)

২) White Ear Head (হোয়াইট হেড বা সাদা শীষ রোগ)


✅১)  Dead Heart (মরা ডিগ বা ডেডহার্ট)

  “আগা শুকিয়ে যাওয়া রোগ”(Dead Heart) মরা ডিগ বা ডেডহার্ট লক্ষণ। যা কুশি অবস্থায় আক্রমন করে থাকে। 



✅ ২) White Ear Head (হোয়াইট হেড বা সাদা শীষ রোগ)

“সাদা শীষ রোগ” (White Ear Head) হোয়াইট হেড লক্ষণ।ধানের পিআই বা পেনিকেল ইনিশিয়েশান বা থোড় /শীষ আসার প্রাথমিক অবস্থা থেকে ফুল হওয়া অবস্থা পর্যন্ত সময়।




⏩  মাজরা পোকার আক্রমণে ক্ষতির লক্ষণ সমূহ : 


♥ এ পোকাগুলো ফসলে বীজতলা থেকে ফসল পাকা পর্যন্ত আক্রমণ করতে পারে। 



♥কীড়ার প্রথমাবস্থায় এক একটি ধানের গুছির মধ্যে অনেকগুলো করে গোলাপী ও কালোমাথা মাজরার কীড়া জড়ো হতে দেখা যায়। 


♥কিন্তু হলুদ মাজরা পোকার কীড়া ও পুত্তলীগুলো কান্ডের মধ্যে যে কোন জায়গায় পাওয়া যেতে পারে।



♥মাজরা পোকা শুধু কীড়া অবস্থায় ধান গাছের ক্ষতি করে থাকে। 




🔰ক্ষতির প্রকৃতি


♥ মাজরা পোকার কীড়াগুলো ডিম থেকে ফুটে রেরুবার পর  সদ্য ফোটা কীড়াগুলো দুই/চারদিন গাছের খোল পাতার মধ্যে থাকে। 



♥হলুদ মাজরা পাতার উপরে ও নীচে ডিম পারে ও ডিমের গাদার উপর হালকা ধূসর রংয়ের আবরন পড়ে।



♥ আস্তে আস্তে কান্ডের ভেতরে প্রবেশ করে। ভিতরের নরম অংশ কুড়ে কুড়ে খায় এবং গাছের ডিগ পাতার গোড়া কেটে ফেলে। ফলে ডিগ পাতা মারা যায়। একে  ‘মরা ডিগ’ বা ‘ডেডহার্ট ’ বলে।



♥গাছে শীষ আসার পূর্ব/ আগ পর্যন্ত এ ধরনের ক্ষতি হলে মরা ডিগ দেখতে পাওয়া যায়। এবং ডিগ টান দিলে সহজেই উঠে আসে।


 


♥শীষ আসার পর মাজরা পোকা ক্ষতি করলে সম্পূর্ণ শীষ শুকিয়ে যায়। একে ‘সাদা শীষ’, ‘মরা শীষ’ বা ‘হোয়াইট হেড’ বলে।



♥মাজরা পোকার আক্রমণ হলে, কান্ডের মধ্যে কীড়া, তার খাওয়ার নিদর্শন ও মল পাওয়া যায়, অথবা কান্ডের বাইরের রং বিবর্ণ হয়ে যায় এবং কীড়া বের হয়ে যাওয়ার ছিদ্র থাকে।


♥ খরায় বা ইঁদুরের ক্ষতির নমুনা হোয়াইট হেড-এর মত দেখা যেতে পারে। কীড়া যদি পাতার খোলের ভেতরে খায় এবং কান্ডের ভেতরের অংশ সম্পূর্ণভাবে কেটে না দেয় তাহলে ধানগাছের আংশিক ক্ষতি হয় এবং শীষের গোড়ার দিকের কিছু ধান চিটা হয়ে যায়।




♥ক্রিসেক রোগের অথবা ইঁদুরের ক্ষতির নমুনার সাথে মাঝে মাঝে মাজরা পোকা দ্বারা সৃষ্ট ক্ষত মরা ডিগ বলে ভুল হতে পারে। মরা ডিগ টান দিলেই সহজে উঠে আসে। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত গাছের কান্ডে মাজরা পোকা খাওয়ার দরুণ ছিদ্র এবং খাওয়ার জায়গায় পোকার মল দেখতে পাওয়া যায়। 




♥গাছে মাজরা পোকার ডিমের গাদা দেখলে বুঝতে হবে গাছের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।




♥আলোর চার পাশে যদি প্রচুর মাজরা পোকার মথ দেখতে পাওয়া যায় তাহলে বুঝতে হবে ক্ষেতের মধ্যে মথগুলো ডিম পাড়া শুরু করেছে।




♥ বিস্ময়কর তথ্য হলো, হলুদ মাজরা পোকার একাধিক কীড়া যৌথভাবে একটি কুশিকে খায় না বরং একটি কীড়া একটি কুশিকে খেয়ে নষ্ট করে পরবর্তীতে অন্য একটি কুশিতে আক্রমন করে বিধায় ধান ক্ষেতের বেশি ক্ষতি হয়।



🔰মাজরা পোকার আক্রমণে অনুকূল পরিবেশ


সাধারণত এই পোকার আক্রমণ চৈত্রের শুরুতে তীব্রতর হয় এবং বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত বিদ্যমান থাকে এরপর আষাঢ়-শ্রাবণে আক্রমণ কমতে থাকে, কিন্তু আশ্বিন-কার্তিক মাসে আবার আক্রমণ বেশ তীব্রতর হয়।


উচ্চ ফলনশীল জাতে এই পোকা বেশি আক্রমণ করে।


অধিক মাত্রায় ইউরিয়া সার প্রয়োগ করলে।


সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১৭-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ধানের সব কয়টি পর্যায়ে যদি তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর বেশি না হয়।


উষ্ণ ও আর্দ্রযুক্ত আবহাওয়া অর্থাৎ ৮০-৯০% আপেক্ষিক আর্দ্রতা এই পোকার সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত।


♥আক্রমনের উপযুক্ত সময়- অক্টোবর – ডিসেম্বর মাসে সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং মার্চ – এপ্রিলের শেষে প্রচণ্ড ক্ষতি করে।





🔰মাজরা পোকার দমন ব্যবস্থাপনা


⏩ ১) যান্ত্রিক দমন


√√#    নিয়মিতভাবে ক্ষেত পর্যবেক্ষণের সময় মাজরা পোকার মথ ও ডিম সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেললে মাজরা পোকার সংখ্যা ও ক্ষতি অনেক কমে যায়। 


√√#থোর আসার পূর্ব পর্যন্ত হাতজাল দিয়ে মথ ধরে ধ্বংস করা যায়।



√√#    মাজরা পোকার পূর্ণ বয়স্ক মথের প্রাদুর্ভাব যখন বেড়ে যায় তখন ধান ক্ষেত থেকে ২০০-৩০০ মিটার দূরে আলোক ফাঁদ বসিয়ে মাজরা পোকার মথ সংগ্রহ করে মেরে ফেলা যায়।


√√# জমির আশেপাশে আগুন জ্বালিয়ে এই পোকার মথ মারতে হবে।


√√#    চারা লাগানোর পরপরই জমিতে পর্যাপ্ত পরিমানে ডালপালা বা খুটি পুঁতে পোকা খেকো পাখির বসার সুযোগ করে দিলে এরা পূর্ণবয়স্ক মথ খেয়ে এদের সংখ্যা কমিয়ে ফেলে।


√√# মাটি পরীক্ষা করে জমিতে সুষম সার দিন।



⏩ ২) জাত প্রতিরোধী দমন

পোকা ও রোগ প্রতিরোধী জাতের ব্যবহার করতে হবে। আগাম ও স্বল্প জীবনকালের ধান যেমন ব্রি ধান৩২, ব্রি ধান৫৬, ব্রি ধান৬২ সহ বিনা ৭ ধান চাষ করতে পারেন। অতিরিক্ত নাইট্রোজেন সার ব্যবহার পরিহার করতে হবে। এক্ষেত্রে সুষম সার ব্যবহার করতে হবে।


প্রতি বিঘা জমিতে ২ টি ফেরোমোন ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে। ফাঁদ লাগানোর জন্য এমন দন্ড ব্যবহার করতে হবে যাতে পাখি বসতে পারে।




⏩ ৩) ভৌত দমন


ধান কাটার পরে জমির নাড়া ও ডিমগুচ্ছ সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলতে হবে


খুব শীঘ্রই চাষ দেওয়া উচিত। এতে শীত ঘুমে থাকা লার্ভা এবং পিউপাগুলির মৃত্যু ঘটে


ধান রোয়ার আগে ডিমগুচ্ছ বিতরনের জন্য ডগা ছেঁটে ফেলে দিতে হবে।



⏩ ৪) পরিচর্যামূলক দমন

√√♦পরিষ্কার-পরিছন্ন চাষবাস (যেমন সময়মত আগাছা দমন, সময়মত সুষম সার প্রয়োগ ইত্যাদি) দরকার


√√♦গ্রীষ্মকালে কোন চাষ করলে পোকার ডিম সহ বাচ্চার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।


√√♦আক্রান্ত গাছগুলিকে গোড়াসহ তুলে পুড়িয়ে দিতে হবে। পাতার উপর ডিমের গুচ্ছ দেখলে ডিম সহ পাতাটিকে মাটিতে পুঁতে দিতে হবে।


√√♦  যে সব অঞ্চলে হলুদ মাজরা পোকার আক্রমণ বেশী, সে সব এলাকায় সম্ভব হলে চান্দিনার (বি আর ১) মত হলুদ মাজরা পোকা প্রতিরোধ সম্পন্ন জাতের ধান চাষ করে আক্রমণ প্রতিহত করা যায়। 


⏩ ৪) জৈবিক দমন

প্রাকৃতিকভাবেও মাজরা পোকা ধ্বংস করা যায়।যেমনঃলেডি বার্ড বিটল, মিরিড বাগ, লম্বাশুড় উড়চুঙ্গা, লম্বাশুড় ঘাসফড়িং, মিরিড বাগ এসব পোকা মাজরা পোকার ডিম খায়। এয়ার উইগ, ক্যারাবিড বিটল, মাইক্রোভেলিয়া, মেসোভেলিয়া, ওয়াটার স্ট্রাইডার, ওয়াটার বোটম্যান, বিভিন্ন জাতের  মাকড়সা যথা নেকড়ে মাকড়সা, লিনক্স, লম্বামুখী ও অর্ব মাকড়সা মাজরা পোকার কীড়া খায়। প্রেয়িং মেনটিড, পাখি, মাছ, ব্যাঙ, ড্যামসেল ফ্লাই, ড্রাগন ফ্লাই এসব প্রাণীরা মাজরা পোকার মথ খেয়ে থাকে। পাখি মাজরা পোকার পুত্তলী খায়।এ গুলোলোকে আমরা বন্ধুপোকা বলি।



⏩ ৫) পরজীবী পোকা দ্বারা দমন

তাছাড়া কিছু পরজীবী পোকা রয়েছে যথা ট্রাইকোগ্রামা, টেলিনোমাস, টেট্রাটিকাস এসব মাজরা পোকার ডিমকে আক্রান্ত করে নষ্ট করে।  ক্যারপস, কোটেশিয়া এসব মাজরা পোকার কীড়াকে বিষাক্ত করে মেরে ফেলে। জ্যান্থোপিমলা, টেমিলোসা, স্টেনোব্রাকন এসব মাজরা পোকার পুত্তলীকে নষ্ট করে। এ ব্যাপারে কৃষক ভাইয়েরা আপনারা সরাসরি পরজীবি পোকার কোন ব্যবস্থা নিতে না পারলেও বালাইনাশক ব্যবহারে সচেতন হলে এসব পরজীবি প্রাণীকুল বেঁচে থেকে সহজেই উপকারে আসতে পারে।


থোড় আসার আগে মরা ডিগ দেখা দিলে বাড়তি কিছু কুশী উৎপাদন করে গাছ আংশিকভাবে ক্ষতি পূরণ করতে পারে। 



√√ভেষজ পদ্ধতিতে দমন (Suppression
of herbal methods)


১.মেহগনির বীজ দ্বারা দমনঃ

 এক কেজি পরিমাণ কাঁচা মেহগনির বীজ পিষে ১০ লিটার পানিতে সিদ্ধ করে এবং ৫০ গ্রাম ডিটারজেন্ট পাউডার সহ মিশিয়ে মিশ্রণটি হেঁকে,জমিতে স্প্রে করুন।


২. পাট বীজ দ্বারা দমনঃ

এক কেজি পাট বীজ আস্তে আস্তে কড়াইতে ভেজে নিন। ভাজা বীজ পিষে ৬০ লিটার পানিতে ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখুন। এইবার হেঁকে ১ বিঘা জমিতে স্প্রে করুন।


সাবধানতাঃ

 কড়াইয়ে ভাজার সময় নাকেরুমাল বা মাক্স ব্যবহার করুন।





মাজরা পোকা ও পাতা মোড়ানো পোকা দমনের জন্য সন্ধ্যার পর ১৫০ সেমি লম্বা লাঠির মাথায় বৈদ্যুতিক বাতি বা হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে রেখে তার নিচে কেরোসিন মিশ্রিত পানির পাত্র রেখে দিলে পোকাগুলো আলোয় এসে ওড়াউড়ির এক পর্যয়ে পাত্রে পড়ে মারা যায়। 


এছাড়া ৩৩ শতাংশের প্রতি বিঘা জমিতে ২০ কেজি তামাকের ডাঁটা পাঁচ সেমি পানির নিচে পুতে রেখে দিলেও পোকা মারা যাবে। 



⏩ ৬)  মাজরা পোকা দমনে বালাইনাশকের ব্যবহার


আপনার ধান ক্ষেতে কুশি অবস্থায় যদি ১০ থেকে ১৫% কুশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে মরাডিগ এবং থোড়ের পর থেকে শিষ বের হওয়া পর্যন্ত সময়ে ৫% কুশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় কেবলমাত্র তখনি কীটনাশক ব্যবহার করতে পারেন। যেহেতু মাজরা পোকার কীড়া গাছের কান্ডের ভিতরে অবস্থান করে তাই সিস্টেমিক জাতীয় বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে। কীটনাশক হিসেবে কার্বোফুরান, এসিফেট, কার্বোসালফান, কারটাপ এসব গ্রুপের বালাইনাশক ব্যবহার করতে পারেন। তাছাড়া ইদানিং থায়ামেথোস্কেম ও ক্লোরানিলিপ্রল গ্রুপের কীটনাশক পরিমিত মাত্রায়, সঠিক সময়ে এবং সঠিক নিয়মে ব্যবহার করে কৃষকরা ভালো উপকৃত হচ্ছে।


ধানের চারা লাগানোর ১৫ দিন পর- প্রথম কিস্তি এবং শীষ আসার পর মাজরা পোকা যাতে ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য চারা লাগানোর ৪০-৪৫ দিন পর স্প্রে করলে ভালো হয়।


বালাইনাশকের নাম গ্রুপের নাম কোম্পানীর নাম প্রয়ােগ মাত্রা
ভিরতাকো ৪০ ডব্লিউজি থাইমিথােল্লাম(২০%)+ক্লোরানিলিপ্রােল(২0%)          সিনজেনটা বাংলাদেশ লিমিটেড বিঘা প্রতি ১০ গ্রামের ১টি প্যাকেট
সিনােফেট ৭৫এসপি এসিফেট অরনি ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড ১৩৩ গ্রাম/বিঘা
ফরওয়াফুরান ৫জি কার্বোফুরান সেতু পেস্টিসাইডস লিঃ ১.৩৩কেজি/বিঘা
ভিটাফুরান ৫জি কার্বোফুরান ম্যাকডােনাল্ড বাংলাদেশ(প্রাইভেট)বি ১.৩৩কেজি/বিঘা
রাজফুরান ৫জি কার্বোফুরান এসিআই ফর্মুলেশনস লিঃ ১.৩৩কেজি/বিঘা
অটোটাফ ৩জি কার্বোফুরান অটো ক্রপ কেয়ার লিঃ ২.২৪ কেজি/বিঘা
মার্শাল ৬জি কার্বোসালফান এফএমসি কেমিক্যাল ইন্টারন্যাশনাল ১.৩৩ কেজি/বিঘা
এমকোসাল ২০ইসি কার্বোসালফান এথারটন ইমব্রুস কোম্পানী লিঃ ২০০মিঃলিঃ/বিঘা
করসালফান ৬জি কার্বোসালফান করবেল কেমিক্যাল ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিঃ ১.৩৩কেজি/বিঘা
বাইসালফান ২০ইসি কার্বোসালফান বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল ইন্ডাস্ট্রি ২০০মিঃ লিঃ/বিঘা
রাজেক্স ৪জি কারটাপ ম্যাকডােনাল্ড ক্রপ কেয়ার লিঃ ১.৮০কেজি/বিঘা
রাইডার ৫০এসপি কারটাপ এথারটন ইমব্রুস কোম্পানী লিঃ ১৮৭ গ্রাম/বিঘা
সিকোটাপ ৫০এসপি কারটাপ সেতু কর্পোরেশন লিঃ ১৮৭ গ্রাম/বিঘা
পাইরিফস ২০ইসি ক্লোরােপাইরিফস ম্যাকডােনাল্ড বাংলাদেশ(প্রাইভেট) লিঃ ২০০মিঃলিঃ/বিঘা
ক্লোরােসিড ২০ইসি ক্লোরােপাইরিফস করবেল ইন্টারন্যাশনাল লিঃ ১৩৩ মিঃলিঃ/বিঘা
এমকোজিনন ১০জি ডায়াজিনন এথারটন ইমব্রুস কোম্পানী লিঃ ২.২৪ কেজি/বিঘা
সেবিয়ন ১০জি ডায়াজিনন ম্যাকডােনাল্ড বাংলাদেশ(প্রাইভেট)লিঃ ২.২৪ কেজি/বিঘা
রিজেন্ট ৫০এসসি ফিপ্রনিল বিএএসএফ বাংলাদেশ লিঃ ৬৭ মিঃলিঃ/বিঘা
রেফারী ৩ জিআর ফিপ্রনিল পেট্রোকেম এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ ১.৩৩ কেজি/বিঘা
বেল্ট ২৪ ডব্লিউজি ফ্লবেনডিয়ামাইড বায়ার ক্রপসায়েন্স লিঃ ০.৪ গ্রাম/প্রতি লিটার
ফেডি ৫০ইসি ফেনথােয়েট অটো ক্রপ কেয়ার লিঃ ২২৭ মিঃলিঃ/বিঘা
ভাইটাল ২৫ইসি কুইনালফস ম্যাকডােনাল্ড বাংলাদেশ(প্রাইভেট)লিঃ ২০০মিঃলিঃ/বিঘা


🚫সর্তকর্তাঃ

কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, একই গ্রুপের কীটনাশক একই পােকা দমনের জন্য পর্যায়ক্রমে/প্রতি মৌসুমে ব্যবহার না করে বিভিন্ন গ্রুপের কীটনাশক ব্যবহার করলে ভাল ফলাফল পাওয়া যায়।

ধানের পােকা দমনের জন্য যে সমস্ত গ্রুপের কীটনাশক রা যাবে না-

• সাইপারমেথ্রিন
• আলফা-সাইপারমেথ্রিন
• ল্যামডা-সাইহেলােথ্রিন
• ডেলথামেথ্রিন
• ফেনভালারেট

কারণ এ সমস্ত গ্রুপের কীটনাশক ব্যবহারে পােকার (Resurgence) ঘটে। এছাড়া যে কোন অনুমােদিত কীটনাশক।
যেমন- ক্লোরপাইরিফস এর সহিত উপরে উল্লেখিত যে কোন গ্রুপের মিশ্রন ধানের পােকা দমনের জন্য ব্যবহার করা যাবে না।
যেমন- বিউটি, ক্যারাটে, কারফু, সাসাইড, মিক্সার, ডেয়ার, এটম, কেনভস, সুপারফাস্ট, বর্ডার, দূর্বার, নাইট্রো ও আলটিমা
ইত্যাদি।


যোগাযোগঃ


কৃষি বিষয়ক যে কোন সমস্যার সমাধান ও ফসলের রােগবালাই এবং পােকামাকড় দমনে সঠিক পরামর্শ দিতে আপনার পাশে রয়েছে ekrishi24.অথবা নিকটস্থ “কৃষক তথ্য ও পরামর্শ কেন্দ্র (ফিয়াক)” অথবা “উপ- সহকারী কৃষি অফিসার” এর সাথে যোগাযোগ করুন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url