আমন/রোপা আমন ধানের ফলন বৃদ্ধিতে করনীয়
আমন/রোপা আমন ধানের ফলন বৃদ্ধিতে করনীয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
📢আমন ধানের ফলন বৃদ্ধিতে করনীয়ঃ
'আমন' শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ 'আমান' থেকে যার অর্থ 'আমানত'৷ অর্থাৎ অতীত কাল থেকেই এই মৌসুমে নিশ্চিত ফসল হিসেবে আমন ধান চাষ করা হতো৷ তা কেনই বা নয়? জানেনই তো ১ কেজি ধান উৎপাদন করতে প্রায় ৩০০০-৩৫০০ লিটার পানির প্রয়োজন হয়! যা এই আমন মৌসুমে বৃষ্টির কারনে খুব বেশি সমস্যা তৈরি করে না৷
|
| আমন/রোপা আমন ধানের ফলন বৃদ্ধিতে করনীয় |
📣এখন আসি কিছু বিষয় খোলাসা করি, আমাদের ধান চাষের মৌসুম ৩ টি, যথাঃ আউশ, আমন এবং বোরো৷ জমির হিসাব করতে গেলে ১ শতাংশে ৪৩৫ বর্গফুট, ৩৩ শতাংশে ১ বিঘা, ১০০ শতাংশে ১ একর, ২৪৭ শতাংশে ১ হেক্টর৷ আর সুবর্নচর, নোয়াখালীর হিসেবে ২ শতাংশে ১ কড়া, ৮ শতাংশে ১ গন্ডা, ৪০ শতাংশে ১ কুনি, ৮০ শতাংশে আধাকানি, ১২.৫ গন্ডায় ১ একর, ২০ গন্ডায় ১ কানি, ১৬০ শতাংশে ১ কানি৷ অন্যান্য এলাকার হিসাব নিশ্চয়ই আমরা কমেন্ট এর মাধ্যমে জানতে পারবো৷
📯আমন ধানের প্রকারভেদ
আমন ধান মূলত দুই প্রকার; রোপা আমন ও বোনা আমন। রোপা আমন অন্য জমিতে চারা প্রস্তুত করে, সেই চারা ক্ষেতে রোপণ করে ধান উৎপন্ন হয় বলে এর এরূপ নাম। রোপা আমন আষাঢ় মাসে বীজতলায় বীজ বোনা হয়, শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে মূল জমিতে রোপণ করা হয় এবং কার্তিক-অগ্রহায়ণ-পৌষ (এলাকাভেদে) মাসে ধান কাটা হয়।
বোনা আমন ছিটিয়ে বোনা হয়। চৈত্র-বৈশাখ মাসে মাঠে বোনা আমনের বীজ বপন করা হয় এবং অগ্রহায়ণ মাসে পাকা ধান কাটা হয়। একে ছড়া আমন, বাওয়া আমন বা গভীর পানির আমনও বলা হয়। আমন মৌসুমে যেহেতু আবাদ এলাকা সম্প্রসারণের তেমন সুযোগ নেই তাই ফলন বাড়ানোর জন্য নতুন জাত চাষাবাদের সঙ্গে সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা জরুরি। আমন ধানের ফলন বৃদ্ধিতে করণীয় বিষয় যেমন- ভালো বীজ নির্বাচন, জমি তৈরি, সঠিক সময়ে বপন বা রোপণ, আগাছা দূরীকরণ, সার ব্যবস্থাপনা, পানি ব্যবস্থাপনা, সম্পূরক সেচ, রোগ পোকামাকড় ব্যবস্হাপনা ফলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমি এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আলোচনা করছি৷
📢📣ফলন কিভাবে বৃদ্ধি করবো তা জানার জন্য আমাদের ১ম জানা প্রয়োজন, ধানের বৃদ্ধি পর্যায়গুলো সম্মন্ধে৷ বৃদ্ধি পর্যায় ৩ টি, যথাঃ ১)অঙ্গজ বৃদ্ধি পর্যায় (Vegetative stage), ২) প্রজনন পর্যায় (Reproductive stage), ৩) পরিপক্ক পর্যায়(Mature stage)৷ এই পর্যায়গুলোর যদি সঠিক ব্যবস্হাপনা আমরা করতে পারি তাহলে ভালো ফলন আনয়ন করা সম্ভব৷
📯📯সার ব্যবস্হাপনাঃ
১ম ৪০-৪২ দিন থাকে অঙ্গজ বৃদ্ধি পর্যায় অর্থাৎ কুশি গঠন পর্যায়৷ এসময় সার ব্যবস্হাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ সার প্রয়োগ এর পদ্ধতিকে আমি একটি সহজ পদ্ধতিতে ভাগ করেছি৷ সুবর্নচরে ৮ শতাংশে যেহেতু ১ গন্ডা হিসাব করা হয় সে হিসেবে অনুপাতটা রেখেছি এভাবেঃ ইউরিয়া-টিএসপি-এমওপি-জিপসাম= ৬-৪-৩-২ কেজি৷ অর্থাৎ ১২.৫ গন্ডায় বা ১ একরে ইউরিয়া ৭৫ কেজি, টিএসপি ৫০ কেজি, এমওপি ৩৮ কেজি, জিপসাম ২৫ কেজি আর গোবর ২৫ মন৷ এর বাহিরে মনো দস্তা সার দিতে হবে ৩ কেজি৷ এ সারের মধ্যে পুরো টিএসপি, জিপসাম এবং ২/৩ ভাগ অর্থাৎ ২৬ কেজি এমওপি এবং ২৫ মণ গোবর জমি তৈরির শেষ চাষের সময় মিশিয়ে দিবেন৷ ইউরিয়া সার ৩ কিস্তিতে দিতে হবে, ১ম বার চারা রোপনের ৮-১০ দিনের মাথায় ২৫ কেজি, ২য় বার চারা রোপনের ২৫-৩০ দিনের মাথায় ২৫ কেজি আর ৩য় বার ৪০-৪২ দিনের মাথায় বাকী ২৫ কেজি এবং এমওপি সার বাকী ১২ কেজি প্রয়োগ করতে হবে৷ মনো দস্তা সার চারা রোপনের ১৫-২০ দিনের মাথায় অবশ্যই প্রয়োগ করতে হবে নাহলে গাছ কিছু খাটো কিছু লম্বা হয়ে যায়, গাছ সার সঠিকভাবে গ্রহন করতে না পেরে ফলন কমে যায়৷ তবে শেষ কিস্তি ইউরিয়া সার গাছের অবস্হা বুঝে প্রয়োগ করতে হবে৷ জমিতে যদি পূর্বে লিগুিইম ফসল যেমনঃ সয়াবীন বা যেকোনো ডাল ফসল চাষ করে থাকেন তাহলে শেষ কিস্তি দেওয়ার প্রয়োজন হবে না৷ আর যদি টিএসপি এর পরিবর্তে ড্যাপ সার ব্যবহার করেন তাহলে কেজি প্রতি ৪০০ গ্রাম ইউরিয়া কম ব্যবহার করবেন৷ যদিও মাটি পরীক্ষা করে সার ব্যবহার করাটাই সর্বাপেক্ষা উত্তম৷
📯📯সম্পূরক সেচ :
আমন চাষাবাদ পুরোটাই বৃষ্টি নির্ভর। তবে প্রতি বছর সকল স্থানে বৃষ্টিপাত এক রকম হয় না। এমনকি একই বৎসরের একই স্থানে সবসময় সমানভাবে বৃষ্টিপাত হয় না। আমন মৌসুমে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের প্রায় ৮০% হয়ে থাকে, যা আমন আবাদের জন্য যথেষ্ট। তবে আমনের বৃষ্টিপাত সময়মতো না হলে ফসলের ক্ষতি হতে পারে। বৃষ্টি-নির্ভর ধানের জমিতে যে কোন পর্যায়ে সাময়িকভাবে বৃষ্টির অভাবে খরা হলে অবশ্যই সম্পূরক সেচ দিতে হবে। প্রয়োজনে সম্পূরক সেচের সংখ্যা একাধিক হতে পারে। তা না হলে ফলনে মারাত্মক প্রভাব পড়বে।
📯📯আগাছা দমনঃ
আগাছা দমন বা রগিং করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ ২০-২৫ দিন, ৪০-৪৫ দিন এবং ৬০-৬৫ দিনের মাথায় আগাছা পরিস্কার করে ফেলতে হবে, এতে ফসলে রোগ পোকামাকড় এর আক্রমন কম হবে ফলে ফলন ভালো হবে এবং এখান থেকে বীজও রাখতে পারবেন৷
📯📯রোগ দমনঃ
রোগমুক্ত ফসল পেতে প্রথমেই বীজ শোধন করে নিতে হবে৷ এজন্য প্রতি কেজি বীজের জন্য ১৫-২০ টি জাম পাতা/ কাজম পাতা থেতলে পানির সহিত মিশিয়ে সেখানে ৩০ মিনিট ভিজিয়ে রাখলেই হবে, তাছাড়া হোসেন এগ্রোর প্রোভ্যাক্স কিংবা কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ৩ গ্রাম/ ১ লি পানিতে ৩০ মিনিট ভিজিয়ে রাখলেও ভালোভাবে বীজ শোধন হয়ে যায়৷ খেয়াল রাখতে হবে শোধনকালীন সময়টা, ১ম বীজ ভিজিয়ে রাখার পর যখন মুখ ফেটে যায় তখন জাগ দেয়ার পূর্বে ৩০ মিনিট একাজটি করলে রোগ থেকে অনেকটাই মুক্ত থাকা সম্ভব৷ আর রোগ দেখা দিলে ২৭ লি পানিকে ২ ভাগ করে ৩৫৬ গ্রাম পাথুরে চুন এবং ৩৫৬ গ্রাম তুঁত আলাদাভাবে গুলে একত্রিত করবেন এবং দ্রবনটি আকাশের মতো নীলচে কালার ধারন করলে গাছ ভিজিয়ে স্প্রে করবেন৷ এছাড়া ব্লাস্ট দেখা দিলে ট্রুপার(অটো), নাটিভো ৪০-৪৫ দিনের মাথায় স্প্রে করলে নিরাপদ৷ সিথ ব্লাইট বা ধোড়া সাপের মতো দাগ গোড়ায় দেখা গেলে এমিস্টার টপ ভালো কাজ করে৷ ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতাপোড়া রোগের প্রাথমিক অবস্থায় ৬০ গ্রাম এমওপি, ৬০ গ্রাম থিওভিট ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। থোড় বের হওয়ার আগে রোগ দেখা দিলে বিঘাপ্রতি ৫ কেজি পটাশ সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। এর সহিত ব্যাকট্রল বা ব্যাকটোবান ব্যবহার করলে রোগের প্রকোপ ভালোভাবেই দমন করা যায়৷
📯📯পোকামাকড় দমনঃ
ধানক্ষেতে ডালপালা পুঁতে দিয়ে মাজরা পোকা ও পাতা মোড়ানো পোকার আক্রমণ অনেকাংশে কমানো যায়। আলোক ফাঁদ/সোলার লাইট ট্রাপের সাহায্যে মাজরা পোকা ও পাতা মোড়ানো পোকা, সবুজ পাতা ফড়িং ও গান্ধি পোকার আক্রমণ কমানো যায়। জমি থেকে পানি বের করে দিয়ে চুংগি পোকা, বাদামি গাছ ফড়িং এবং সাদা পিঠ গাছ ফড়িং পোকার আক্রমণ কমানো যায়।ধানের দুধ গঠন অবস্থায় গান্ধী বা মহুয়া পোকার আক্রমণ হলে পুতে রাখা ডালে ২ টি করে ন্যাপথলিন বা কাপুর ঝুলিয়ে দিবেন কারন গান্ধী পোকা গন্ধ ছড়ায় কিন্তু গন্ধ সহ্য করতে পারে না৷ উল্লেখিত ব্যবস্থা গ্রহণের পরও পোকার আক্রমণ বেশি পরিলক্ষিত হলে মাজরা পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা ও চুংগি পোকা দমনের জন্য নাইট্রো(সাইপারমেথ্রিন + ক্লোরোপাইরিফস গ্রুপ) বা সানটাপ ৫০ পাউডার প্রতি বিঘায় ১৮০-১৯০ গ্রাম হারে ব্যবহার করতে হবে। মাজরা পোকা ও পাতা মোড়ানো পোকা দমনের জন্য ভিরতাকো ৪০ ডব্লিউজি প্রতি বিঘায় ১০ গ্রাম হারে ব্যবহার করতে হবে। বাদামি গাছ ফড়িং ও সাদা পিঠ গাছ ফড়িং দমনের জন্য পেদা টিং টিং(ব্যাবিলন), স্পেলেন্ডর(ন্যাশনাল), পাইরাজিন(এসিআই ) মিপসিন(পদ্মা) ৭৫ পাউডার অনুমোদিত মাত্রায়, ব্যবহার করতে হবে। পাতা মোড়ানো পোকা, চুংগি পোকা ও শীষকাটা লেদা পোকা দমনের জন্য কার্বারিল ৮৫ পাউডার অথবা সেভিন পাউডার প্রতি বিঘায় ২২৮ গ্রাম হারে ব্যবহার করতে হবে।
📯📯ফসল কাটা, মাড়াই ও সংরক্ষণ :
শীষে ধান পেকে গেলেই ফসল কাটতে হবে। অধিক পাকা অবস্থায় ফসল কাটলে অনেক ধান ঝরে পড়ে, শীষ ভেঙে যায়, শীষকাটা লেদাপোকা এবং পাখির আক্রমণ হতে পারে। তাই মাঠে গিয়ে ফসল পাকা পরীক্ষা করতে হবে। শীষের অগ্রভাগের শতকরা ৮০ ভাগ ধানের চাল শক্ত হলে ধান ঠিকমতো পেকেছে বলে বিবেচিত হবে। বীজ রাখার ক্ষেত্রে পূর্বেই নির্ধারিত করা ১৫ শতক জমির ধান প্রথমে কেটে কাঠের কোন কিছুর উপর আড়াই বাড়ির মাড়াই দিতে হবে৷ তারপর রোদে শুকিয়ে শুকনো নিম বা নিসিন্দা বা কুটুসকাটাস পাতা দিয়ে বায়ুরোধী পাত্রে বীজ সংরক্ষণ করতে হবে৷
যোগাযোগঃ
কৃষি বিষয়ক যে কোন সমস্যার সমাধান ও ফসলের রােগবালাই এবং পােকামাকড় দমনে সঠিক পরামর্শ দিতে আপনার পাশে রয়েছে ekrishi24.অথবা নিকটস্থ “কৃষক তথ্য ও পরামর্শ কেন্দ্র (ফিয়াক)” অথবা “উপ সহকারী কৃষি অফিসার” এর সাথে যোগাযোগ করুন।
