ধানের ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া/পাতা ঝলসানো রোগ/Bacterial Leaf Blight (BLB) | ধানের রোগ

 ধানের ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া/পাতা ঝলসানো রোগ/Bacterial Leaf Blight (BLB)


এ রোগের গুরুত্ব

ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া রোগের আক্রমণ আউশ, আমন ও বোরো এ তিন মৌসুমেই দেখা  যায়।ধানের যতো কম বয়সের এ রোগ আক্রমণ করবে ফলন ততো কমবে। পাতা পোড়া রোগের কারণে ধানের ফলন ৭০% পযন্ত কমে যেতে পারে।থোড় হওয়ার সময় এ রোগের আক্রমণ হলে ফলনে যেমন ক্ষতি হয় না তবে দানার কোয়ালিটি খুব খারাপ হয় এবং অনেক দানার ভেতরে চাল অসম্পূর্ণ থাকে।ফলে প্রত্যেক বছর ধানের ফলন গড়ে শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ কমে যায়।

পাতা পোড়া রোগের লক্ষণ চারা রােপনের ১৫-২০ দিনের মধ্যে এবং বয়স্ক গাছে থােড় অবস্থায় পাতাপােড়া লক্ষণ দেখা যায়।প্রথমে পাতার অগ্রভাগ থেকে কিনারা বরাবর
ধানের ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া/পাতা ঝলসানো


রোগের নাম

ধানের পাতা পোড়া বা পাতা ঝলসানো রোগ Bacterial Leaf Blight (BLB) (Xanthomonas oryzae pv.oryzae) ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ।



রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু

জ্যানথোমোনাস অরাইজি পিভি অরাইজি (Xanthomonas oryzae pv.oryzae) এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে হয়ে থাকে।



রোগের বিস্তার

উচ্চ তাপমাত্রা ২৫-৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ৭০% এর বেশি আপেক্ষিক আর্দ্রতা, টানা ঝড়ো-বৃষ্টি, রোগপ্রবণ জাত লাগানো,রোপণের সময় শিকড় অথবা গাছে ক্ষত সৃষ্টি, উচ্চ মাত্রায় ইউরিয়া সার প্রয়োগ ইত্যাদির কারণে রোগের প্রকোপ বেশি হয়।এছাড়া পাতাপোড়া রোগ ধানের খড়, মাটি, পোকা, বাতাস,শিশির,বন্যা ও সেচের পানির মাধ্যমে এক জমি থেকে অন্য জমিতে ছড়ায়।



রোগ সৃষ্টি অবস্থায়

চারা অবস্থায় এবং বয়স্ক গাছে এ রোগের লক্ষণ সৃষ্টি হয়।



চারা অবস্থায়

চারা রােপনের ১৫-২০ দিনের মধ্যে এ রোগে দেখা যায়।চারা অবস্থায় একে নেতিয়ে পড়া বা চারা পচা (ক্রিসেক) বলে।



নেতিয়ে পড়া বা চারা পচা (ক্রিসেক)

বীজতলা থেকে চারা তােলার সময় শিকড় ছিড়ে গেলে তখন রােপণের সময় ব্যাকটেরিয়া জীবাণু সে ক্ষতের মধ্য দিয়ে গাছের ভিতরে প্রবেশ করে। এছাড়া কচি পাতার ক্ষত স্থান দিয়েও ব্যাকটেরিয়া জীবাণু প্রবেশ করতে পারে।আক্রান্ত গাছের গােড়া পচে যায়, পাতা নেতিয়ে পড়ে হলুদাভ হয়ে মারা যায়। এই অবস্থাকে কৃসেক বলে।


কৃসেক হলে প্রথমে চারার বাইরের পাতা ও পরে ভেতরের পাতা হলদে হয়ে ক্রমান্বয়ে শুকিয়ে খড়ের রং ধারণ করে ফলে নতুন পাতা ও তেমনি ভাবে শুকিয়ে যায় এবং চারা নেতিয়ে পড়ে। চারার গোড়ায় হাত দ্বারা চাপ দিলে পুঁজের মত দুর্গন্ধযুক্ত পদার্থ বের হয়।



বয়স্ক অবস্থায়

বয়স্ক গাছে সাধারণত থােড় অবস্থা থেকে পাতাপােড়া লক্ষণ দেখা যায়। প্রথমে পাতার অগ্রভাগ থেকে কিনারা বরাবর আক্রান্ত হয়ে নিচের দিকে বাড়তে থাকে। আক্রান্ত অংশ প্রথমে জলছাপ এবং পরে হলুদাভ হয়ে খড়ের রং ধারণ করে। ক্রমশ সম্পূর্ণ পাতাটাই মরে শুকিয়ে যায়।এইভাবে রােগ সমস্ত জমিতে ছড়িয়ে পড়লে ঝলসানো বা পাতা পোড়া বলে মনে হয়।



পাতা  পোড়া রোগের লক্ষণ

• আক্রান্ত গাছের কাণ্ড ছিঁড়ে চাপ দিলে দুর্গন্ধযুক্ত পুঁজের মতো তরল পদার্থ বের হয়।

• হলুদ হয়ে নেতিয়ে পড়া ধান গাছ সহজে উপড়ে ফেলা যায় না।

• রাত ও দিনের তাপমাত্রার পার্থক্য বেশি (৮-১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) হলে কচি পাতায় ফ্যাকাশে হলুদ বর্ণের লক্ষণটি প্রকাশ পায়।



ক্ষত পরীক্ষা করে রোগ শনাক্ত

বয়স্ক ধান গাছে ক্ষতটি প্রথমে পানি শোষক হয়। পরে পাতা, পাতার আগা বা পাতার কোনো কারণে আঘাতপ্রাপ্ত অংশে হলুদাভ কমলা রঙ ধারণ করে।ক্ষতটির কিনারা হয় ঢেউ খেলানো এবং এটি ক্রমেই পাতার গোড়ার দিকে প্রসারিত হয়।


ক্ষতটির বয়স যদি বেশি না হয়, অর্থাৎ আক্রান্তের পরপর সকাল বেলা আক্রান্ত স্থানে দুধের মতো শিশির বিন্দু ঝুলতে দেখা দেয়। এটি আসলে ব্যাকটেরিয়া সমৃদ্ধ একটি তরল। এ তরলটি পরে শুকিয়ে ছোট ছোট হলুদাভ পুঁতির মতো পাতার নিচের দিকে লেগে থাকে।




ব্যাকটেরিয়া সমৃদ্ধ হলুদাভ পুঁতি

ক্ষতির বয়স বেশি হলে সেটি হলুদাভ থেকে ধূসর রঙ ধারণ করে। এতে কালো ডট বা বিন্দু দেখা যায়, কারণ এখানে বিভিন্ন ধরনের ছত্রাক জন্মে। পাতা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হলে ক্ষতটি পাতার গোড়া অবধি প্রসারিত হতে পারে।



সমন্বিত দমন ব্যবস্থাপনা


• চারা উঠানোর সময ক্ষত না হওয়া।

• চারা উঠানোর সময় যেন শিকড় কম ছিঁড়ে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা।

• আক্রমণ প্রবণ জাত চাষ না করা।

• ঝড়-বৃষ্টি অথবা রােগ দেখা দেওয়ার পরপরই ইউরিয়া সারের উপরি প্রয়ােগ বন্ধ রাখতে হবে।

• ইউরিয়া সার প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যবহার না করা।

• সব ইউরিয়া চারা বা কুশি অবস্থায় না দিয়ে ২/৩ কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করা।

• রোগ দেখা দিলে জমির পানি শুকিয়ে ৭-১০ দিন পর আবার পানি দিতে হবে।

• চারা অবস্থায় রোগ দেখা দিলে আক্রান্ত চারা তুলে ফেলে পার্শ্ববর্তী গাছ থেকে কুশি এনে লাগিয়ে দিলে ক্ষতির পরিমাণ কম হবে।

• ধান কাটার পর জমিতে নাড়া ও কড় পুড়ে ফেলাপ।

• বৃষ্টি না হলে সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।


★ জমিতে পানি থাকলে, পটাশ সার (প্রতি বিঘায় ৫কেজি হারে) ও জিপসাম (প্রতি বিঘায় ৩ কেজি হারে) উপরি প্রয়ােগ করতে হবে।


★ তাছাড়া যে সকল ফসল অধিক হলুদ হয়ে আছে সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত বিঘা প্রতি ২ কেজি হারে ফসফরাস (টিএসপি/ ডিএপি) সার স্প্রের মাধ্যমে প্রয়ােগ করা যেতে পারে।


★ জমি শুকনা থাকলে, কুইক পটাশ/ ফাস্ট পটাশ/ নিম পটাশ (প্রতি লিটার পানিতে ৩ গ্রাম হারে) ও থিয়ােভিট/ কুমুলাস (প্রতি লিটার পানিতে ৫ গ্রাম হারে) একত্রে স্প্রে করতে হবে।



যোগাযোগ 

কৃষি বিষয়ক যে কোন সমস্যার সমাধান ও ফসলের রােগবালাই এবং পােকামাকড় দমনে সঠিক পরামর্শ দিতে আপনার পাশে রয়েছে ekrishi24.অথবা নিকটস্থ “কৃষক তথ্য ও পরামর্শ কেন্দ্র (ফিয়াক)” অথবা “উপ সহকারী কৃষি অফিসার” এর সাথে যোগাযোগ করুন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url