ব্রি ধান ২৮ এর জাত পরিচিতি, বৈশিষ্ট্য ও চাষ পদ্ধতি
ব্রি ধান ২৮ এর জাত পরিচিতি, বৈশিষ্ট্য ও চাষ পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা
বোরো মৌসুমের জাতগুলোতে কোন আলোক সংবেদনশীলতা নেই। এ মৌসুম শুরু হয় ঠাণ্ডা ও ছোট দিন দিয়ে, আর ফুল ফোটে গরমের শুরুতে এবং বড় দিনে। তাই আলোক সংবেদনশীল কোন জাত বোরো মৌসুমে আবাদ করা উচিত নয়।
|
| ব্রি ধান ২৮ এর জাত পরিচিতি, বৈশিষ্ট্য ও চাষ পদ্ধতি |
জাত পরিচিতি
ব্রি ধান ২৮ বােরা মৌসুমের একটি আগাম জাত।এ জাত ১৯৯৪ সালে চাষাবাদের জন্য অনুমোদিত হয়।
জাতের বৈশিষ্ট্য
• গাছের উচ্চতা ৯০ সেমি।
• পাকার সময় ধানের শীষ উপরে থাকে।
• চাল মাঝারি চিন ও সাদা।
• ভাত ঝর ঝরে ও খেতে সুস্বাদু।
• আগাম বিধায় বন্যার পানিতে পাকা ধান তলিয়ে যায় না।
• এ ধানের মুড়ি ভালাে হয়।
জীবনকালঃ জাতটির জীবনকাল ১৪০ দিন
ফলনঃ স্বাভাবিক ফলন হেক্টরপ্রতি ৫.৫-৬.০ টন।
চাষ পদ্ধতি
বীজতলায় বীজ বপনঃ ১- ১৫ অগ্রহায়ণ (১৫-২৯ নভেম্বর)।
চারার বয়সঃ ৩৫ থেকে ৪৫ দিন বয়সের চারা লাগানো উত্তম।
চার রোপনের সময়ঃ
৭-১২ মাঘ (২০শে জানুয়ারি থেকে ২৫শে জানুয়ারি)।বোরো ধানের রোপণ ১৫ মাঘের মধ্যে শেষ করা উচিত।
চারার সংখ্যাঃ
প্রতি গুছায় ২-৩ টি চারা রোপন করতে হবে। রোপনের সময় জমিতে সামান্য পরিমাণ পানি থাকলেই চলে।
রােপণ দূরত্বঃ
সারি হতে সারির দূরত্ব ৮ ইঞ্চি (২০ সে.মি.) এবং সারিতে গুছি হতে গুছির দূরত্ব ৬ ইঞ্চি (১৫ সে.মি.) বজায় রাখতে হবে।
বীজ বাছাইঃ
বপনের জন্য পুষ্ট ও সুস্থ বীজ নিশ্চিত করতে হবে। কারণ ভাল বীজ মানে সবল চারা। বিভিন্ন পদ্ধতিতে (হাত বা কুলা দিয়ে, ইউরিয়া মিশ্রিত পানিতে ভিজিয়ে) বীজ বাছাই করা যায়। বীজ বাছাইয়ের একটি ভালো পদ্ধতি হলো-
দশ লিটার পরিষ্কার পানিতে ৩৭৫ গ্রাম ইউরিয়া সার মেশাতে হবে। এবার ১০ কেজি বীজ ছেড়ে হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দিতে হবে। পুষ্ট বীজ ডুবে নিচে জমা হবে এবং অপুষ্ট, হালকা বীজ ভেসে উঠবে। হাত অথবা চালনি দিয়ে ভাসমান বীজগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে। ভারী বীজ নিচ থেকে তুলে নিয়ে পরিষ্কার পানিতে ৩-৪ বার ভাল করে ধুয়ে নিতে হবে। ইউরিয়া মেশানো পানি সার হিসেবে বীজতলায় ব্যবহার করা যায়। বপনের আগে বীজ শোধন করে নেওয়া ভালো। প্রতি ১০ কেজি বীজে ২৫ গ্রাম ভিটাভেক্স- ২০০ ব্যবহার করা যেতে পারে। বাকানি রোগপ্রবণ এলাকায় আবশ্যিক ভাবে ছত্রাকনাশক দ্বারা বীজ শোধন করতে হবে।
আদর্শ বীজতলা তৈরীঃ
বীজতলার জন্য দোআঁশ ও এটেল দোআঁশ মাটি, খরকুটা ও আবর্জনা মুক্ত জমি নির্বাচন করে২-৩ ইঞ্চি পানি দিয়ে ২/৩ টি চাষ ও মই দিয়ে ৭-১০ দিন পানি ভালভাবে পানি আটকিয়ে রাখতে হবে। আগাছা খড় ইত্যাদি পচে গেলে আবার চাষ ও মই দিয়ে থকথকে কাঁদাময় করে জমি তৈরি করতে হবে। যদি জমি অনুর্বর হয় তাহলে প্রতি বর্গমিটার জমিতে দুই কেজি হারে জৈব সার (পঁচা গোবর বা আর্বজনা) ছড়িয়ে দিতে হবে। এরপর ৩ মিটার দীর্ঘ (১০ ফুট) ও ১ মিটার প্রস্থ (৩ ফুট) হওয়া প্রয়োজন। অথবা প্রয়োজনমত বেড তৈরি করতে হবে এবং নালার জন্য ২৫-৩০সেমিঃ বা ১০-১২ ইঞ্চি জায়গা ফাঁকা রাখতে হবে।এবং প্রতি বর্গমিটার বীজতলায় ৮০-১০০ গ্রাম হারে সমানদূরত্বে বীজ বপন করা উচিৎ। এরূপ এক বর্গ মিটার বীজতলার চারা দিয়ে ২৫-৩০ বর্গমিটার জমিতে রোপণ করা যাবে।
বীজতলার পরিচর্যা
বীজতলা থেকে চারা উঠানোঃ
চারা যত্ন সহকারে উঠানো দরকার যাতে চারা গাছের কান্ড ভেঙ্গে না যায়। চারা গাছের শিকড় বা পাতা ছিঁড়ে বা কান্ড মচকে গেলে চারা গাছের বিশেষ ক্ষতি হয়। তাই চারা উঠানোর পূর্বে বীজতলাতে বেশি করে পানি দিতে হবে যাতে বীজতলার মাটি ভিজে নরম হয়। চারা উঠানোর পর ওই চারার পাতা দিয়ে বান্ডিল বাঁধাও উচিৎ নয় । শুকনো খড় ভিজিয়ে নিয়ে বান্ডিল বাঁধতে হবে।
পাখি তাড়ানোর ব্যবস্থা
বীজ বেডের উপর থাকে বলে পাখিদের নজরে পড়ে। তাই বপনের সময় থেকে ৪/৫ দিন পর্যন্ত পাহারা দিয়ে পাখি তাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে এবং নালা ভর্তি করে পানি রাখতে হবে।
অতিরিক্ত ঠান্ডায় বীজতলার যত্নঃ
শীতের রাতে সাদা পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখলে বীজতলা অতিরিক্ত ঠান্ডাজনিত ক্ষতি থেকে রক্ষা পায়। তাছাড়া বীজতলা দিনে খোলা এবং রাতে সাদা পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখলে চারার বৃদ্ধি ভাল হয়। ফলে এ পদ্ধতিতে জন্মানো চারা রোপন করা সহজ হয় । চারার গুনগত মান ভাল হওয়ায় ফলনও তুলনামূলক ভাবে ভালো হয়।
জমি তৈরিঃ
সারের পরিমাণঃ
| সারের নাম | প্রতি বিঘায় (৩৩ শতকে) |
|---|---|
| ইউরিয়া | ৩০-৪০ কেজি। |
| টিএসপি | ৭-১০ কেজি। |
| এমওপি | ৮-১৬ কেজি। |
| জিপসাম | ৪-১১ কেজি। |
| জিঙ্ক সালফেট (দস্তা) | ০.৭-১.০কেজি। |
সার প্রয়োগ পদ্ধতিঃ
প্রথম উপরি প্রয়োগ রােপণের ১৫-২০ দিন পর।
দ্বিতীয় উপরি প্রয়ােগ রােপণের ৩০-৩৫ দিন পর ।
ধানের চারা রোপণের কাইচথোর আসার পর ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করা যাবে না।
গুটি ইউরিয়ার ব্যবহারঃ
ইউরিয়ার পরিবর্তে গুটি ইউরিয়া ব্যবহারের ফলে ইউরিয়া সারের কার্যকারিতা
শতকরা ২০-২৫ ভাগ বৃদ্ধি পায়। ফলে ইউরিয়া সার কম লাগে। গুটি ইউরিয়া সার
একবারই ব্যবহার করতে হয়। এ সার প্রয়োগের পূর্বশর্ত হলো সারিবদ্ধভাবে ধান
রোপন করতে হবে। বোরো মৌসুমে ২.৭ গ্রাম ওজনের ১ টি গুটি চারা রোপনের ১০-১৫
দিন এবং আউশ ও আমন মৌসুমে ১.৮ গ্রাম ওজনের ১ টি গুটি ৭-১০ দিনের মধ্যে এক
সারি পর পর প্রতি চার গোছার মাঝখানে ৩-৪ ইঞ্চি কাদার গভীরে পুঁতে দিতে
হবে (নিম্নের চিত্র অনুযায়ী)। গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ করলে আউশ ও আমন মৌসুমে
প্রতি হেক্টরে ৬৫ কেজি এবং বোরো মৌসুমে ৮০-১০০ কেজি ইউরিয়া সাশ্রয় হয়।
আগাছা দমনঃ
রােপণের পর ৪০ দিন পর্যন্ত জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
সেচ ব্যবস্থাপনাঃ
ফসল কাটাঃ
১৫-৩১ বৈশাখ (১-২৫ মে) মাসে ধান কাটার উপযুক্ত হয়।ধান কাটার সময় ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি উচ্চতায় ধান গাছ কাটতে হবে। ধান গাছের বাকি অংশ জমি চাষ দেয়ার সময় মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে।
ধানের ভাল ফলন ও সঠিক গুনাগুন সম্পন্ন ধান পেতে হলে কতিপয় নির্দেশনা মেনে চলতে হবে-
১। সঠিক সময়ে ধান কর্তন করতে হবে।
২। সঠিক পদ্ধতিতে মাড়াই,ঝাড়াই ও শুকাতে হবে।
৩। সঠিক পদ্ধতিতে বীজ সংরক্ষণ করতে হবে।
অধিক পাকা অবস্থায় ফসল কাটলে অনেক ধান ঝরে পড়ে, শীষ ভেঙ্গে যায়, শীষকাটা লেদাপোকা এবং পাখির আক্রমণ হতে পার। তাই মাঠে গিয়ে ধান পেকেছে কিনা তা দেখতে হবে। শীষের শতকরা ৮০ ভাগ ধানের চাল শক্ত ও স্বচ্ছ হলে ধান ঠিকমতো পেকেছে বলে বিবেচিত হবে। কাটার পর ধান মাঠে ফেলে না রেখে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাড়াই করা উচিত।কাঁচা খোলার উপর ধান মাড়াই করার সময় চাটাই, চট বা পলিথিন বিছিয়ে দিন। এভাবে ধান মাড়াই করলে ধানের রং উজ্জ্বল ও পরিষ্কার থাকে। মাড়াই করা ধান অন্তত ৪-৫ দিন রোদে ভালভাবে শুকানোর পর ঝেড়ে গোলাজাত করতে হবে।
যোগাযোগ
কৃষি বিষয়ক যে কোন সমস্যার সমাধান ও ফসলের রােগবালাই এবং পােকামাকড় দমনে সঠিক পরামর্শ দিতে আপনার পাশে রয়েছে ekrishi24.অথবা নিকটস্থ “কৃষক তথ্য ও পরামর্শ কেন্দ্র (ফিয়াক)” অথবা “উপ সহকারী কৃষি অফিসার” এর সাথে যোগাযোগ করুন।
