হলুদ চাষাবাদ
বৈজ্ঞানিক নামঃ Curcuma longa
জগৎ:Plantae
বর্গ:Zingiberales
পরিবার:Zingiberaceae
গণ:Curcuma
প্রজাতি:C. long
জলবায়ু ও মাটিঃ
হলুদ উষ্ণ, অবউষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুর ফসল। ছায়া, আধোছায়া, বৃষ্টিপাত সমৃদ্ধ
পাহাড়ি অঞ্চলে হলুদ জন্মে তবে প্রখর রোদযুক্ত জায়গায় বেশি কন্দ উৎপন্ন হয়। কম
তাপমাত্রায় বা ঠান্ডায় হলুদের বৃদ্ধি কমে যায়। দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটিতে হলুদ
ভালো জন্মে।
জাত পরিচিতিঃ
উচ্চফলনশীল জাত হিসেবে প্রথম আসে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ডিমলা ও
সিন্দুরী জাত দুটি। ডিমলা জাতটি স্থানীয় জাতের তুলনায় ৩ গুণ এবং সিন্দুরী জাতটি
স্থানীয় জাতের তুলনায় ২ গুণ ফলন বেশী দেয়। দুটি জাতই লিফ ব্লাইট রোগ প্রতিরোধ
ক্ষমতা সম্পন্ন। এছাড়াও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বারি হলুদ-৩ , বারি
হলুদ-৪ ও বারি হলুদ-৫ নামে আরও তিনটি জাত আছে । এর পাশাপাশি বেশ কিছু স্থানীয়
জাতের হলুদ দেশের বিভিন্ন এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে চাষ হয়ে আসছে । এসব জাতের মধ্যে
উল্লেখযোগ্য- হরিণপালি, আদাগতি, মহিষবাট, পাটনাই, আড়ানী ইত্যাদি ।
বীজহারঃ
প্রতি হেক্টরে ২ থেকে ৩ টন বীজের দরকার।
বীজ বপন পদ্ধতিঃ
পাহাড় বা ঢালু জমিতে দা দিয়ে গর্ত করে বা কোদাল দিয়ে জমি তৈরি করে হলুদ লাগাতে
হবে। প্রথমে পাহাড়ের জঙ্গল পরিষ্কার করে এক বিঘত বা ২০ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার
দূরত্বে গর্ত করে সেখানে বীজ বপন করতে হবে। সমতলে বা কম ঢালুতে সারিতে বপন করতে
হবে। সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ৫০ সেন্টিমিটার। প্রতি সারিতে ২৫ সেন্টিমিটার
পরপর বীজকন্দ লাগাতে হবে। লাগানোর পর রোপিত কন্দের উপরে ৫ থেকে ৭ সেন্টিমিটার
পুরু করে শুকনো খড় বিছিয়ে দিতে হবে। একে মালচিং বলে।
ফসল সংগ্রহঃ
হলুদ ৮ থেকে ৯ মাসের ফসল। হলুদ পরিণত হয়ে এলে গাছ শুকাতে শুরু করে। গাছ
পুরোপুরি শুকিয়ে গেলে হলুদ তোলা উচিত। তাহলে সেসব হলুদ মজুদ করলে বেশ ভালো
থাকে। সাধারণত জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে হলুদ উঠানো বা তোলা শুরু হয়। তবে যেসব
হলুদগাছ রোগে আক্রান্ত হয়ে পরিণত হওয়ার আগেই শুকিয়ে যায় সেগুলো আগেই তুলে ফেলতে
হয়। এজন্য পাহাড়ি এলাকায় কোথাও কোথাও নভেম্বরের শেষ থেকে হলুদ তোলা শুরু হয়।
এসব হলুদের মান বেশি ভালো হয় না এবং চাষিরা ফলনও কম পায়। গাছ, জমি ও আবহাওয়ার
অবস্থা বুঝে মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত হলুদ তোলা যেতে পারে। কোদাল দিয়ে
মাটি কুপিয়ে হলুদ মাটি থেকে ছাড়িয়ে তোলা হয়। কোপানো বা মাটি আলগা করার সময়
অবশ্যই খেয়াল রাখা দরকার হলুদের ফাণা বা মোথা যেন কোদালের কোপে কাটা না পড়ে।
ফলনঃ
উফশি বা আধুনিক জাতসমূহ চাষ করলে হেক্টরে ২৫ থেকে ৩০ টন হলুদ পাওয়া যায়। ১০০
কেজি কাঁচা হলুদ থেকে ২৫ থেকে ৩০ কেজি শুকনা হলুদ পাওয়া যায়।
কিউরিংঃ
হলুদের রাইজোম পরিষ্কার করার পর মোথা ও ছড়া পৃথক করতে হবে। সংগ্রহকৃত রাইজোম
ছায়াযুক্ত পরিষ্কার স্থানে গাদা করে রাখা হয়। একে কিউরিং বলে। ২-৩ দিন হলুদের
কিউরিং করা হয়। কিউরিং শেষ হলে বীজ হিসেবে সংরক্ষণ বা খাওয়ার জন্য সিদ্ধ করে
প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়।
আন্তঃপরিচর্যাঃ
১) আগাছা ব্যবস্থাপনা ও ভেলি বাঁধাঃ
হলুদ দীর্ঘমেয়াদি ফসল বলে হলুদের জমিতে ৪ বার নিড়ানি দিয়ে আগাছা সাফ করতে হয়।
বীজকন্দ লাগানোর ২৫ থেকে ৩০ দিন পর প্রথম আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। এরপর
যথাক্রমে রোপণের ৫০, ৮০ ও ১০০ থেকে ১২০ দিন পর আগাছা নিড়াতে হবে। দুই কিস্তির
সার উপরি প্রয়োগের ঠিক আগে আগাছা পরিষ্কার করে সার ছিটাতে হবে। এসময় সার দেওয়ার
পর দুবারই গাছের গোড়ায় মাটি তুলে ভেলি বেঁধে দিতে হবে। এতে হলুদের বাড়-বাড়তি
ভালো হয়। তাছাড়া বৃষ্টি হলে ভেলির নালাপথে সে পানি যেন সহজে জমি থেকে বেরিয়ে
যেতে পারে সেজন্য ভেলিগুলোর শেষপ্রান্তে নিকাশ নালাও রাখা দরকার। হলুদের জমিতে
যেন পানি জমতে না পারে সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। পানি জমে থাকলে কন্দ পচে
নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
২) মালচিংঃ
হলুদ লাগানোর পর পাতা বা খড় দিয়ে জমি ঢেকে দেওয়া দরকার। এতে জমির রস ঠিক থাকে ও
চাষের ফলে আলগা হয়ে যাওয়া, মাটি সরে যাওয়া বা ভূমিক্ষয় রোধ হয়। কাঁচা বা সবুজ
লতাপাতা দিয়ে ঢেকে দিলে কয়েকদিন পর সেসব পচে জমির মাটিতে জৈব পদার্থ যোগ হয়ে
উর্বরতা বাড়ায়।
সেচ ব্যবস্থাপনাঃ
পাহাড়ি হলুদে কোনো সেচের দরকার হয় না। স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতেই হলুদ ভালো হয়।
সমতলে জমি খুব শুকিয়ে গেলে নালা বা ভেলির মুখ বন্ধ করে সেচ দেওয়া যেতে পারে।
তবে বেশিক্ষণ পানি থাকলে বা মাটি খুব বেশি ভিজে গেলে তা কন্দ পচতে সাহায্য করতে
পারে।
বীজ শোধনঃ
ছত্রাকনাশক ব্যবহার করে বীজ শোধন করা যায়। যেসব এলাকায় হলুদে কন্দপচা রোগ বেশি
হয় সেসব এলাকায় বীজ রোপণের আগে শোধন করে নিতে হবে। এজন্য প্রতি ১০ লিটার পানিতে
২০ গ্রাম এমকোজিম/রিডোমিল গোল্ড/ডায়থেন এম ছত্রাকনাশক গুলে সেই পানিতে ২০ কেজি
হলুদ ৩০ মিনিট চুবিয়ে রাখতে হবে। এরপর পানি থেকে বীজ তুলে ছায়ায় শুকিয়ে নিয়ে
মূল জমিতে লাগাতে হবে।
বীজ তৈরিঃ
সুস্থ-সবল বীজকন্দ নির্বাচন করতে হবে। প্রতিটি বীজকন্দে অন্তত ২টি চোখ থাকতে
হবে। বীজকন্দের আকার (ওজন) ২০ থেকে ৩০ গ্রাম হতে হবে। বীজ রোগ ও পোকামাকড় মুক্ত
থাকতে হবে। বীজকে ধারালো ছুরি দিয়ে কাটতে হবে। বীজকে ভাঙা যাবে না। কাটার পর বা
লাগানোর আগে ছায়াযুক্ত স্থানে শুকাতে হবে। প্রয়োজনে কাটা জায়গায় ছাই মাখিয়ে
দেওয়া যেতে পারে। মোথা বীজ হিসেবে উত্তম। এতে ফলন বেশি হয়।
জমি নির্বাচনঃ
ভালো নিকাশ ব্যবস্থাযুক্ত উঁচু জমি হলুদ চাষের জন্য বেছে নিতে হবে। এঁটেল মাটি
ও লবণাক্ত এলাকায় হলুদের জমি নেওয়া যাবে না। খরাপ্রবণ এলাকাতেও হলুদ ভালো হয়
না। যেসব অঞ্চলে নিয়মিত বৃষ্টিপাত হয় অথচ বৃষ্টির পানি জমে থাকে না, সেসব
অঞ্চলে হলুদ ভালো হয়। সে বিবেচনায় পাহাড়ের ঢালে হলুদ চাষ করা যায়। পাহাড়ে কিছু
বৃক্ষ বা অন্য গাছ লাগানো থাকলেও তার নিচে হলুদ চাষ করা যায়।
জমি তৈরিঃ
অপেক্ষাকৃত কম ঢালু বা প্রায় সমতল ও সমতল জমিতে এভাবে জমি লাঙ্গল বা পাওয়ার
টিলার দিয়ে চাষ করে জমি তৈরি করা যায়। এরূপ জমি পরিষ্কার করে ভালোভাবে ৪ থেকে
৫টি চাষ দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। চাষের সময় হেক্টর প্রতি ১০ থেকে ১৫ টন গোবর
সার বা জৈব সার ও ইউরিয়া বাদে অন্যান্য রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে।
মাটি শোধনঃ
ভাল ফলন পেতে হলে বীজ ও মাটিবাহিত রোগ হতে হলুদ ফসলকে মুক্ত রাখার জন্য মাটি
শোধন করা আবশ্যক। শেষ চাষের আগে ফুরাডান বা কুরাটার ৫ কেজি হেক্টর হারে প্রতি
২৫-৩০ কেজি প্রয়োগ করতে হবে।
সারের পরিমাণঃ
হলুদ চাষের জন্য প্রতি হেক্টরে সারের সুপারিশকৃত মাত্রা
| সার | মোট পরিমাণ | জমি তৈরির সময় প্রয়োগ | উপরি সার প্রয়োগ | ||
|---|---|---|---|---|---|
|
১ম কিস্তি (কন্দ রোপণের ৫০-৬০ দিন পর) |
২য় কিস্তি (১ম কিস্তির ৫০-৬০ দিন পর) |
৩য় কিস্তি (২য় কিস্তির ৫০-৬০ দিন পর) |
|||
| জৈব সার | ১০ টন | ১০ টন | - | - | - |
| ইউরিয়া | ২২০ কেজি | - | ১১০ কেজি | ৫৫ কেজি | ৫৫ কেজি |
| টিএসপি | ১৮০ কেজি | ১৮০ কেজি | - | - | - |
| এমওপি | ২০০ কেজি | ১০০ কেজি | - | ৫০ কেজি | ৫০ কেজি |
| জিপসাম | ১১০-১২০ কেজি | ১১০-১২০ কেজি | - | - | - |
| জিংক সালফেট(যদি লা) | ৩.৫-৪.০ কেজি | ৩.৫-৪.০ কেজি | - | - | - |
সার প্রয়োগ পদ্ধতিঃ
সম্পূর্ণ জৈব সার, টিএসপি সার, জিপসাম, জিংক অক্সাইড ও অর্ধেক এমওপি সার জমি
প্রস্তুত করার ৭ দিন আগে এবং অবশিষ্ট এমওপি সারের অর্ধেক রোপণের ৫০ দিন পর দুই
সারির মাঝে প্রয়োগ করতে হবে। বাকি সারটুকু প্রথমবার উপরি প্রয়োগের অন্তত ৫০ দিন
পর অর্থাৎ বীজকন্দ লাগানোর ১০০ দিন পর ছিটিয়ে দিতে হবে। দ্বিতীয় কিস্তির ইউরিয়া
সার দিতে হবে এর ৫০ থেকে ৬০ দিন পর।
বীজ বোনার সময়ঃ
মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত হলুদের বীজ বোনা বা
লাগানো যায়। তবে চৈত্র মাস অর্থাৎ মধ্য মার্চ থেকে মধ্য এপ্রিল হলুদের বীজকন্দ
লাগানোর উত্তম সময়। দেরিতে হলুদ লাগালে শুধু গাছের দৈহিক বৃদ্ধি ঘটে, মোথা বা
হলুদ কম হয়। এজন্য ফলন কমে যায়।
Add Comment
comment url