গ্রীষ্মকালীন বারি হাইব্রিড টমেটো-৮ চাষ পদ্ধতি | টমেটো চাষ
গ্রীষ্মকালীন বারি হাইব্রিড টমেটো-৮ চাষ পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা
টমেটা মূলত শীতকালীন ফসল। বারি টমেটো-৮ কৃষকেরা শীত ও গ্রীষ্ম উভয় মওসুমেই চাষ করে সারা বছর ফলন পাবেন।তাই বারি টমেটো-৮ সারা বছর চাষ করা যায়।অসময়ের টমেটো হওয়ায় কৃষকেরা বারি টমেটো-৮ ভালো দামে বিক্রি করে আর্থিক লাভবান হতে পারবেন। এটি একটি উচ্চ তাপ সহিষ্ণু উচ্চফলনশীল গ্রীষ্মকালীন জাত। আকর্ষণীয় লালবর্ণ বিশিষ্ট এর ত্বক এবং শাঁস। ফল বেশ মাংশল।বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত এ টমেটোর উৎপাদনমতা সাধারণ জাতের টমেটোর তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।এ জন্যই বারি হাইব্রিড টমেটো-৮ চাষে কৃষকের আগ্রহ বাড়ছে।
|
| গ্রীষ্মকালীন বারি হাইব্রিড টমেটো-৮ চাষ পদ্ধতি |
পরিচিতিঃ
ফসল : টমেটো
জাতের নাম : বারি হাইব্রিড টমেটো-৮
উদ্ভাবনকারী প্রতিষ্ঠান : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি)
গড় জীবনকাল প্রায় (দিন): ৯০ দিন।
ফলনের গুণগত বৈশিষ্ট্য : ফল আকারে মাঝারি গোল ও আকর্ষণীয় লাল রঙের।
জাতের ধরণ : হাইব্রি
সিরিজ সংখ্যাঃ ৮।
আরও জানতে নিছে ক্লিক করুন
পুষ্টিগুনঃ
টমেটোর পুষ্টিগুন নানাবিধ যেমন খনিজ পদার্থ, আঁশ, খাদ্যশক্তি, আমিষ,
ক্যালসিয়াম, আয়রন, ক্যারোটিন,ভিটামিন বি-১, ভিটামিন বি-২ ও শর্করা ইত্যাদি।
জাতের বৈশিষ্ট্য :
এ জাতের প্রতিটি গাছে গড়ে ৩০ টি ফল ধরে। গাছ প্রতি ফলন ১.৫ কেজি। প্রতিটি ফলের
গড় ওজন ৫০ গ্রাম। চারা লাগানোর ৬০ দিনের মধ্যে ফল পাকতে শুরু করে। এবং ২০-২৫
দিন ধরে ফল সংগ্রহ করা যায়। গ্রীষ্মকালে ফল ধারণের জন্য হরমোন প্রয়োগের প্রয়োজন
হয় না। তবে হরমোন প্রয়োগ করলে ফলন দিগুন করা যায় এবং ফলন অনেক বৃদ্ধি পায়।
১। উচ্চ তাপমাত্রায় ফুল ও ফল ধারনে সক্ষম ।
২। আকর্ষনীয় লাল বর্ণ বিশিষ্ট ত্বক এবং শাস ।
৩। হরমোন প্রয়োগ ছাড়াই গ্রীষ্মকালে চাষাবাদ করা যায় ।
৪। ফল বেশ মাংশল ।
৫। ফলের আকৃতি flattened round ধরনের ।
৬। গাছ প্রতি ফলন ৪০-৪৫টি ।
৭। ফলন ৩৫-৪০টন/হেঃ ।
৮।শতক প্রতি ফলন (কেজি) : ১৬০ - ১৬৫
৯।হেক্টর প্রতি ফলন (টন) : ৪০
মাটিঃ
উপযোগী ভূমির শ্রেণী : মাঝারি উচু , মাঝারি নিচু জমি , অতি নিচু জমি
উপযোগী মাটি : বেলে-দোআঁশ
উৎপাদনের মৌসুম : খরিফ-২
চাষাবাদ পদ্ধতিঃ
♥প্রতি শতক বীজতলায় বীজের পরিমান : ০.৮ গ্রাম - ০.৮১ গ্রাম।
♥লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব (ইঞ্চি ) : ২৪। এবং
♥চারা থেকে চারার দূরত্ব (ইঞ্চি) : ১৮।
♥বপনের সময় : সেপ্টেম্বর- অক্টোবর (শীতকালে), মে-জুলাই
(গ্রীষ্ম-বর্ষাকালে)।
♥মাড়াইয়ের সময় :ফল ধারনের ৩৫ দিনের মধ্যে ফল সংগ্রহ করা যায়।
ফসল তোলার সময় : ৬০ দিন।
সার ব্যবস্থাপনাঃ
| সারের নাম | শতক প্রতি সার | শেষ চাষের সময় | ১ম কিস্তিত | ২য় কিস্তিত | ৩য় কিস্তিত |
|---|---|---|---|---|---|
| পঁচা গোবর/কম্পোস্ট | ৪০ কেজি | সবটুকু গোবর /কম্পোস্ট সার | - | - | - |
| ইউরিয়া | - | - | ১০ দিন পর উপরি প্রয়োগ | ২৫ দিন পর উপরি প্রয়োগ | ৪০ দিন পর উপরি প্রয়োগ |
| ১.২০ কেজি | - | ৪০০ গ্রাম | ৪০০ গ্রাম | ৪০০ গ্রাম | |
| টি এস পি | ৮১০ গ্রাম | সবটুকু টি এস পি সার | - | - | - |
| এমওপি/পটাশ | - | অর্ধেক এমওপি/পটাশ সার | ২৫ দিন পর উপরি প্রয়োগ | ৪০ দিন পর উপরি প্রয়োগ | - |
| ৯৭০ গ্রাম | ৪৮৫ গ্রাম | ২৪২ গ্রাম | ২৪২ গ্রাম | - | |
| জিপসাম | ০.৩৮ কেজি | সবটুকু জিপসাম | - | - | - |
| জিংক সালফেট | ০.০৫ কেজি | সবটুকু জিংক সালফেট | - | - | - |
| বোরিক অ্যাসিড | ০.০৩ কেজি | সবটুকু বোরিক অ্যাসিড | - | - | - |
টমেটো চাষের আনুমানিক খরচঃ
খরচ হিসেবে এখানে প্রতি শতকে ২-৩ হাজার টাকার বাঁশ, ৩০০-৩৫০ টাকার জিআই তার,
পলিথিন-৫৫০০ টাকার এবং সার ও জমি তৈরির খরচ লাগে।
সেচ ব্যবস্থাপনা :
চারা রোপণের ৩-৪ দিন পর পর্যন্ত হালকা সেচ ও পরে প্রতি কিস্তিতে সার উপরি
প্রয়োগের পর জমিতে সেচ দিতে হয়। গ্রীষ্ম মৌসুমে টমেটো চাষের জন্য ঘন ঘন সেচের
প্রয়োজন হয়। বর্ষা মৌসুমে তেমন একটা সেচের প্রয়োজন হয় না। টমেটো গাছ
জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। সেচ দেওয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে, সেচের পানি
কখনোই যেন বেডের উপর উঠে না আসে। নালাতে সেচ দিতে হবে, নালা থেকে শোষণের
মাধ্যমে বেড ও গাছ পানি সংগ্রহ করতে হবে।
সেচ ও নিকাশ পদ্ধতি :
সেচের জন্য ১২-১৫ ইঞ্চি চওড়া, ৬ ইঞ্চি গভীর সেচ ও নিষ্কাশন নালা রাখতে হবে।
তাছারা ঝাঝরা বা মাটির কলস দিয়ে সেচ দেয়া। প্রতিটি সেচের পর মাটির উপরিভাগের
চটা ভেঙ্গে দিতে হবে।
পোকামাকড়ঃ
টমেটোর ডগা ও ফলছিদ্রকারী এবং পাতা মোড়ানো পোকা দমনে
থায়ামিথক্সাম+ক্লোথায়ারানিলিপ্রল জাতীয় কীটনাশক (যেমন ভলিউম ফ্লেক্সি ৫
মিলিলিটার অথবা ১মুখ ) অথবা সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক (যেমন ওস্তাদ
২০ মিলিলিটার ৪ মুখ অথবা ম্যাজিক অথবা কট ১০ মিলিলিটার ২ মুখ ) প্রতি
১০লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে স্প্রে করতে হবে ১০-১২ দিন পরপর
২/৩ বার। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
শোষকপোকা/হেপার/শ্যামাপোকা, জাবপোকা এবং সাদামাছি দমনে ইমিডাক্লোরোপ্রিড
জাতীয় কীটনাশক (যেমন এডমায়ার অথবা টিডো ৭-১০ মিলিলিটার / ২মুখ) অথবা
কারবারাইল জাতীয় কীটনাশক (যেমন সেভিন ২০ গ্রাম) ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি
৫ শতকে স্প্রে করতে হবে ১০ দিন পরপর ২/৩ বার। ঔষোধ পাতার নিচের দিকে
যেখানে পোকা থাকে সেখানে স্প্রে করতে হবে।
টমেটোর কাটুইপোকা দমনে কারটাপ জাতীয় কীটনাশক ( কেয়ার ৫০ এসপি অথবা সানটাপ ৫০
এসপি ২০ মিলি / ৪ মূখ ) অথবা ল্যামডা-সাইহ্যালোথ্রিন জাতীয় কীটনাশক (
ক্যারাটে ২.৫ ইসি অথবা ফাইটার প্লাস ২.৫ ইসি ১৫ মিলি / ৩ মূখ ) ১০ লিটার
প্রতি ৫ শতকে স্প্রে করতে হবে ১০ দিন পরপর ২/৩ বার।
রোগবালাইঃ
টমেটোর ছত্রাক জনিত ঢলে পড়া, আগাম ধ্বসা এবং নাবীধ্বসা রোগদমনে ম্যানকোজেব
জাতীয় ছত্রাকনাশক যেমন ( রিডোমিল গোল্ড ২০ গ্রাম) অথবা
কার্বান্ডিজম জাতীয় ছত্রানাশক যেমন (এমকোজিম ৫০ ; অথবা
গোল্ডাজিম ৫০০ ইসি ১০ মিলি /২ মুখ ) ১০ লি পানিতে মিশিয়ে ৭ দিন পরপর ৩
বার গাছের গোড়ায় ও মাটিতে স্প্রে করুন
# আক্রমণ বোশি হলে প্রথম থেকে প্রতি লিটার পানিতে ২গ্রাম
রোভরাল মিশিয়ে স্প্রে করুন।ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
বুশি স্টান্ট( লিফ হপার নামক পোকা দ্বারা ছড়ায়) দেখা দিলে আক্রান্ত গাছ তুলে
পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
মোজাইক রোগ ও পাতা কোকড়ানো রোগদমনে জমিতে জাব পোকা দেখা গেলে (বাহক
পোকা) ইমিডাক্লোরোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক (যেমন এডমায়ার অথবা টিডো ১০ মি.লি. ২
মুখ ) ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে স্প্রে করতে হবে। সকাল বেলা গাছে
ছাই ছিটিয়ে দিলে এই পোকা গাছ থেকে পড়ে যাবে৷ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন
করতে হবে।
বালাইনাশক ব্যাবহারের সতর্কতাঃ
বালাইনাশক/কীটনাশক ব্যবহারের আগে বোতল বা প্যাকেটের গায়ের লেবেল ভালো করে
পড়ুন এবং নির্দেশাবলি মেনে চলুন। ব্যবহারের সময় নিরাপত্তা পোষাক পরিধান করুন।
ব্যবহারের সময় ধূমপান এবং পানাহার করা যাবেনা। বালাইনাশক ছিটানো জমির পানি
যাতে মুক্ত জলাশয়ে না মেশে তা লক্ষ্য রাখুন। বালাইনাশক প্রয়োগ করা জমির
ফসল কমপক্ষে সাত থেকে ১৫দিন পর বাজারজাত করুন।
আগাছাঃ
আগাছা দমনের জন্য জমি চাষ ও মই দিয়ে ভালোভাবে আগাছা পরিষ্কার, বিশুদ্ধ
বীজ ব্যবহার এবং পরিষ্কার কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার। ফসল বোনার ২৫-৩০দিনের
মধ্যে আগাছা বাছাই করতে হবে।সেচ দেয়ার আগে আগাছা বাছাই করতে হবে।
সেচঃ
চারা রোপণের ৩-৪ দিন পর পর্যন্ত হালকা সেচ ও পরে প্রতি কিস্তিতে সার
উপরি প্রয়োগের পর জমিতে সেচ দিতে হয়। গ্রীষ্ম মৌসুমে টমেটো চাষের জন্য ঘন ঘন
সেচের প্রয়োজন হয়। বর্ষা মৌসুমে তেমন একটা সেচের প্রয়োজন হয় না। টমেটো গাছ
জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। সেচ দেওয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে, সেচের পানি
কখনোই যেন বেডের উপর উঠে না আসে। নালাতে সেচ দিতে হবে, নালা থেকে শোষণের
মাধ্যমে বেড ও গাছ পানি সংগ্রহ করতে হবে।
আবহাওয়া ও দুর্যোগঃ
অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি নালা কেটে বের করে দিতে হবে ।
সংরক্ষনঃ
প্রাকৃতিক উপায়ে টমেটো সংরক্ষণের জন্য পাকা, আধা পাকা বা রঙ চড়া
অবস্থায় টমেটো বোটাসহ গাছ থেকে খুবই সাবধানতার সাথে সংগ্রহ করতে হবে; যেন কোন
অবস্থাতেই টমেটো থেকে বোটা আলাদা না হয়ে যায়। এছাড়া সতর্ক থাকতে হবে যেন
টমেটোর গায়ে কোন ধরনের আঘাত না লাগে। গাছ থেকে টমেটো সংগ্রহ করার পর বাড়িতে
এনে সেগুলোকে বাছাই করতে হবে। যেন কোন টমেটো পোকাযুক্ত ও গায়ে কোন দাগ না
পড়ে। সংগ্রহ করা টমেটোর মধ্যে যদি এ ধরনের চিহ্ন যুক্ত কোন টমেটো থাকে তাহলে
সেটা সংরক্ষণের জন্য বাছাই না করাই ভালো ভালো বলে তিনি জানান। কারণ এ
দাগযুক্ত টমেটো খুব দ্রুত নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বাছাইকৃত টমেটোগুলো যে
স্থানে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে রাখা হবে সে জায়গা পরিস্কার করতে হবে। স্থান
নির্বাচনের ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকতে হবে। এমন জায়গা নির্বাচন করতে হবে যেন সেটা
শুষ্ক এবং পর্যাপ্ত আলো বাতাসের ব্যবস্থা থাকে। সাধারণত পাকা ঘরের মেঝে বা
শুকনা মাটির জায়গাগুলো সংরক্ষণ স্থান হিসেবে উপযুক্ত। ছায়াযুক্ত, ভেজা ও আলো
বাতাসহীন জায়গা হলে টমেটো দ্রুত পচে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আবার এমনভাবে
টমেটোগুলো রাখতে হবে যাতে একটু ফাঁকা ফাঁকা থাকে। একটি টমেটো থেকে আরেকটি
টমেটোর মধ্যে আলো বাতাস চলাচল করতে পারে।
যোগাযোগঃ
কৃষি বিষয়ক যে কোন সমস্যার সমাধান ও
ফসলের রােগবালাই এবং পােকামাকড় দমনে সঠিক
পরামর্শ দিতে আপনার পাশে রয়েছে ekrishi24.অথবা নিকটস্থ “কৃষক তথ্য ও পরামর্শ
কেন্দ্র (ফিয়াক)” অথবা “উপ সহকারী কৃষি অফিসার” এর সাথে যোগাযোগ করুন।
