বেগুন গাছের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা দমন পদ্ধতি | বেগুনের পোকা ও বালাই

বেগুন গাছের ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকা দমন পদ্ধতি


পোকার নাম : 

ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা।পোকার বৈজ্ঞানিক নাম Leucinodes orbonalis, ইংরেজীতে Brinjal shoot and fruit borer নামে পরিচিত।এছাড়াও বিভিন্ন স্থানীয় নাম রয়েছে। যেমন- আলমারা, ডগাভাঙা এবং ফল ছিদ্রকারী পোকা।


পোকা চেনার উপায় :

ছোট আকারের মথ, ৮-১২ মি মি লম্বা সাদা রং এর দুই জোড়া পাখাতে ছিট ছিট বাদামি দাগ থাকে,স্ত্রী মথ আকারে বড় হয়।


বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা ইংরেজীতে Brinjal shoot and fruit borer ও বৈজ্ঞানিক Leucinodes orbonalis নামে পরিচিত.এটি ৮-১২ মি.মি লম্বা সাদা রং মথ হয় এবং দুই জোড়া পাখাতে ছিট ছিট বাদামি দাগ থাকে,স্ত্রী মথ আকারে বড় হয়।                
  ekrishi24,বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা দমন                

পোকার পরিচিতিঃ

•বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা এটি বেগুনের  ক্ষতিকর পোকা।
•পাখায় বাদামী দাগযুক্ত সাদা রঙের স্ত্রী মথ কচি ডগা, ফুল, কুঁড়ি এবং ফলের বৃতিতে একটি একটি করে ডিম পাড়ে। 
•ডিম ফুটে লালচে গোলাপী রঙের কীড়া ফুল, কুঁড়ি, কচি ডগা ও বৃতি ছিদ্র করে ভিতরে ঢোকে। 
•আক্রান্ত ফল থেকে কীড়া বের হয়ে মাটিতে পুত্তলী অবস্থায় থাকে। 
•শীতের শেষে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে এই পোকার আক্রমণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়।
•পোকার আক্রমনে ক্ষেত্রবিশেষে ৮৫ ভাগ পর্যন্ত ফলনের ক্ষতি হয় ।



পোকার ক্ষতির বিবরনঃ


√√পূর্ণবয়স্ক পোকা একটি মথ। মথগুলো শেষরাতে উড়াউড়ি করে। তাই এদেরকে সহজে দেখতে পাওয়া যায় না। মথ কম বয়সী ডগার উপরে ডিম পাড়ে। ডিম থেকে কীড়া বের হয়ে ডগায় ঘুরে বেড়ায়। 

√√পূর্ণতা প্রাপ্ত হওয়ার পর কীড়া কোকুনে পরিণত হওয়ার জন্য ফল থেকে সুড়ঙ্গ তৈরী করে মাটিতে নেমে আসে।কীড়া বের হওয়ার ছিদ্র ফলে স্পষ্ট দেখা যায়,তবে ডগায় এই ছিদ্র পরিলক্ষিত নাও হতে পারে।ফল থেকে বের হওয়ার পর কীড়া শুকনো ঝরা পাতার সাথে কোকুন   তৈরি করে।এই  কোকুনের ভেতর থেকে কীড়া পূর্ণাঙ্গ মথ বের হয়ে আসে।

√√ডিম দেওয়ার জন্য স্ত্রী মথ পুরুষ মথের সাথে মিলিত হয়। একটি মথ সারা জীবনে ২৫০টি পর্যন্ত ডিম দেয়।

√√সাধারণত অন্য বেগুনের জমি বা আশপাশের পুরনো শুকনা বেগুন গাছের স্তূপ থেকে পোকার মথ জমিতে আসে এবং পরে ডগা ও ফলে বংশবৃদ্ধি করে। 


ক্ষতির ধরণ/লক্ষণ:


↪️বেগুন ফসলের জমিতে সাধারণত চারা রোপণের ৪-৫ সপ্তাহ পর  থেকেই বেগুনের কচি ডগায় ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ শুরু হয়। 

↪️তবে বেগুন গাছে ফুল আসা শুরু হওয়ার পর আক্রমণের মাত্রা বাড়তে থাকে ।

↪️পোকার কিড়া/লেদা ফুলের কুঁড়ি, পাতার বোটা, কচি ডগা ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে সুড়ঙ্গ তৈরি করে। ।এবং কুরে কুরে খেয়ে সেখানেই বড় হতে থাকে।সুড়ঙ্গ সৃষ্টি করার ফলে কচি ডগা ঢোলে পড়ে এবং অবশেষে মারা যায়। একইভাবে কীড়া ফল ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে শাঁস খায়।

↪️আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে বেগুন পচতে শুরু করে এবং ঝড়ে পড়ে। অনেক সময় গাছও মারা যায়।

 ↪️কিছুদিনের মধ্যে আক্রান্ত ডগাগুলো শুকিয়ে আসে এবং পাশ থেকে নতুন শাখা প্রশাখা বের হয়। 

↪️গাছে ফুল ফল আসার পর ডগার তুলনায় ফুল ফলে এই পোকার আক্রমন বেশী দেখা যায়। 

↪️আক্রান্ত বেগুনের গায়ে কীড়ার মলসহ ছিদ্র দেখা যায় এবং বেগুন কাটলে ভিতরে মল ও পচা সুড়ঙ্গ দেখা যায়।এবং ছিদ্র বা সুড়ঙ্গ পথে কীড়া বের হতে দেখা যায়। 

↪️বেশী মাত্রায় আক্রান্ত হলে ফল পঁচতে থাকে এবং ঝরে পড়ে। 

↪️গ্রীষ্মকালে এ পোকা বেশী সক্রিয় থাকে। সাধারনত শীতের শেষে যখন তাপমাত্রা ও আদ্রতা বাড়তে থাকে তখন এ পোকার আক্রমন বেশী দেখা যায়।অন্যদিকে শীতকালে এ পোকার আক্রমনের হার কম থাকে। 

↪️তবে পূর্ণতা প্রাপ্ত হওয়ার পর কীড়া পুত্তলিতে পরিণত হওয়ার জন্য ফল থেকে সুড়ঙ্গ তৈরী করে মাটিতে নেমে আসে । কীড়া বের হওয়ার ছিদ্র ফলে স্পষ্ট দেখা যায় তবে ডগায় এই ছিদ্র পরিলক্ষিত নাও দেখা যেতে পারে ।



পোকা নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন উপায় রয়েছে-


🔃মানসম্পন্ন বীজের ব্যবহার করতে হবে।

🔃বীজে কোনো রোগ বা ক্ষতিকর কিছু না থাকে তা নিশ্চিত হতে হবে।

🔃 আক্রান্ত গাছ আছে কি না তা দেখার জন্য দিনে অন্তত দুইবার ক্ষেত পরিদর্শন করা।

🔃গাছের নিচের পুরোনো পাতাগুলো সরিয়ে ফেলুন।

🔃ঝরা পাতাগুলো সরিয়ে পুড়িয়ে ফেলুন।যাতে করে পোকা কোকুন তৈরি করতে না পারে

🔃সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ্য করুন, কোনো ডগা শুকিয়ে যাচ্ছে কি-না।

🔃ধারালো ছুরি দিয়ে আক্রান্ত ডগা, ফুল বা ফল কেটে ফেলুন। সেগুলো সরিয়ে মাটির নিচে পুঁতে ফেলুন।


 🔃ক্ষেতের ধারে-কাছে আক্রান্ত জিনিসগুলো ফেলবেন না। এতে নতুন মথ জন্ম নিতে পারে।

🔃 ক্ষেতের চারপাশে জালের বেড়া দিয়ে পোকার আক্রমণ ঠেকানো যেতে পারে।

🔃মথকে দূরে রাখতে জালটির ছিদ্র ছোট হতে হবে। এবং তিন মিটার উঁচু জাল ব্যবহার করতে হবে,মথ সাধারণত তিন মিটারের উপরে উড়তে পারে না।

🔃সাদা নাইলনের জাল ব্যবহার করুন। সাদা জাল ফসলের উপরে ছায়া দেয় না।

🔃এতে পাখিরাও বেগুন গাছের ফুল এবং কচি ফল নষ্ট করতে পারে না।

🔃একই জমিতে বার বার বেগুন চাষ না করা,আর টবে চাষের ক্ষেত্রে প্রতিবার মাটি পরিবর্তন করে দেওয়া।

🔃সূর্য ওঠার আগে খুব সকালে মথগুলো বেগুন গাছের কচি ডগায় উড়ে-উড়ে ডিম পাড়ে।তাই উড়ন্ত মথগুলো দেখে ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলুন।

🔃ক্ষেতে ফেরোমন ফাঁদ বা বিভিন্ন ধরনের পোকা ধরার ফাঁদ কিনে ব্যবহার করতে পারেন।বিভিন্ন পোকার বিভিন্ন গন্ধ বা ফেরোমন থাকে।

 🔃ফেরোমন ফাঁদ ১০-১২ মিটার দূরে-দূরে পাতুন।

🔃প্রতিদিন ফেরোমন ফাঁদ পরখ করুন। দরকার হলে ডিটারজেন্ট পানি রিফিল ও পরিবর্তন করুন।

🔃স্থাপনের ৪০ দিন পরপর ফেরোমন টোপ বদলান।



জৈবিক ও যান্ত্রিক পদ্ধতিতে দমনঃ


★বেগুনের জমি গভীরভাবে চাষ করা ও আগাছা মুক্ত রাখা। 

★আক্রান্ত ফল, ডগা ধারালো কাচি দিয়ে কেটে জমি থেকে দূরে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলা অথবা মাটি চাপা দেওয়া,এতে গাছের আক্রান্ত অংশসমূহে বিদ্যমান পোকার কীড়া বা লার্ভা মারা যায় এবং জমিতে পোকার আক্রমণ কমে আসে


★১ লিটার পানিতে ৫০ গ্রাম আধাভাঙ্গা নিমবীজ ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে, ছেঁকে আক্রান্ত গাছে ১০ দিন পর পর ৩ বার স্প্রে করলে এই পোকা নিয়ন্ত্রন করা যায়।

★ক্ষেতে সেক্স ফেরোমন বা বিভিন্ন ধরনের পোকা ধরার ফাঁদ কিনে ব্যবহার করতে পারেন।বিভিন্ন পোকার বিভিন্ন গন্ধ বা ফেরোমন থাকে।

★ফেরোমন ফাঁদ ১০-১২ মিটার দূরে-দূরে একটি ফাঁদ গাছের উচ্চতার উপর খুটি দিয়ে স্থাপন করতে হবে।

★চারা লাগানোর ৪-৫ সপ্তাহ পর ফাঁদ স্থাপন করতে হবে এবং ৪০ দিন বা তিন মাস পরপর ফাঁদ পরিবর্তন করে দিতে হবে।

★প্রতিদিন ফেরোমন ফাঁদ পরখ করুন। দরকার হলে ডিটারজেন্ট পানি রিফিল ও পরিবর্তন করুন।

★সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে পুরুষ মথ ধরে এদের বংশ কমানো। 


★উপকারী পোকার ব্যবহারঃ 

ট্রাইকোগ্রামা(Tricogramma chilonis) ও ব্রাকন(Bracon habetor) নামক দুটি উপকারী পোকা ব্যবহার করে এই পোকার আক্রমণ ব্যপকভাবে কমানো যায়। ট্রাইকোগ্রামা এই পোকার ডিমগুলো খেয়ে ফেলে আর ব্রাকন পোকার লার্ভাগুলো খায়। হেক্টর প্রতি ১ গ্রাম ট্রাইকোগ্রামা এবং ৮০০-১২০০ টি ব্রাকন উপকারী পোকা পর্যায়ক্রমে ছাড়তে হবদাম


রাসায়নিক পদ্ধতিতে দমন


বালাইনাশকের নাম গ্রুপের নাম প্রয়োগ মাত্রা কোম্পানীর নাম         
প্লেনাম ৫০ ডব্লিউজি পাইমেট্রোজিন ১০ গ্রাম +১৬ লিটার পানি সিনজেনটা বাংলাদেশ লিঃ
একতারা ২৫ ডব্লিউজি থিয়ামিথােক্সাম ২ গ্রাম +১৬ লিটার পানি সিনজেনটা বাংলাদেশ লিঃ
ট্রেসার* ৪৫ এস সি স্পিনোসাড (Spinosad) ১০ লিটার পানিতে ৪ মিলি অটো ক্রপ কেয়ার লিমিটেড
ভলিয়মফ্লেক্সি ৩০০ এসসি ক্লোরানট্রানিলিপ্রোল + থাইম্যাথক্সাম প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিঃলিঃ হারে সিনজেনটা বাংলাদেশ
সানটাপ ৫০ এসপি কারটাপ ২.৪০ গ্রাম/প্রতি লিটার পানি ম্যাকডোনাল্ড বাংলাদেশ (প্রাইভেট) লিমিটেড
কনফিডর ৭০ ডব্লিউডিজি ইমিডাক্লোপ্রিড ১.১২ গ্রাম +১৬ লিটার পানি বায়ার ক্রপসায়েন্স লিমিটেড
কট ১০ ইসি সাইপারমেথ্রিন ১ মিলি/প্রতি লিটার পানি এসিআই ফর্মুলেশনস লিমিটেড
রিপকর্ড ১০ ইসি সাইপারমেথ্রিন ০.৫ মিলি/প্রতি লিটার পানি বিএএসএফ বাংলাদেশ লিমিটেড
ফেনকর্ড ১০ ইসি সাইপারমেথ্রিন ২ মিলি/প্রতি লিটার পানি এথারটন ইমব্রুস কোম্পানী লিমিটেড
ম্যাজিক ১০ ইসি সাইপারমেথ্রিন ০.৫ মিলি/প্রতি লিটার পানি রেক্সিমকো ইনসেক্টিসাইডস লিমিটেড



গাছের ফুল আসার সময় হতে প্রতি ২ সপ্তাহ  অন্তর ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে ।


★কেমিক্যাল ব্যবহারের ক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে যে একই কেমিক্যাল বারবার ব্যবহার করা যাবে না, কারণ এই পোকা কেমিক্যাল এর প্রতি রেসিস্টেন্ট পাউয়ার তৈরি করতে পারে,তাই কেমিক্যাল গুলো অল্টারনেট করে ব্যবহার করতে হবে।


স্প্রে করার ১৫ দিনের  মধ্যে সেই ফল খাওয়া যাবে না বা বিক্রি করা যাবে না।



✳️♦ যোগাযোগঃ

কৃষি বিষয়ক যে কোন সমস্যার সমাধান ও ফসলের রােগবালাই এবং পােকামাকড় দমনে সঠিক পরামর্শ দিতে আপনার পাশে রয়েছে ekrishi24.অথবা নিকটস্থ “কৃষক তথ্য ও পরামর্শ কেন্দ্র (ফিয়াক)” অথবা “উপ সহকারী কৃষি অফিসার” এর সাথে যোগাযোগ করুন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url