মুখীকচু চাষ এর আধুনিক ও উন্নত পদ্ধতি
মুখীকচু চাষে উন্নত কলাকৌশল
ekrishi24: মুখীকচু বাংলাদশে বিভিন্ন নামে পরচিতি। মুখীকচু খুবই সুস্বাদু ও পুষ্টিকর সবজি। তাছাড়া মুখীকচু শুধু পুষ্টি পূরণ করে না, রোগ প্রতিরোধেও ভূমিকা রাখে। মাত্র ১০০ গ্রাম কচুতে থাকে ২৬৬ ক্যালরি। এ ছাড়া আছে আমিষ ১.৮ গ্রাম, শর্করা ৩২.৪ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ২২ মিলিগ্রাম, শ্বেতসার, লৌহ, ফসফরাস এবং ভিটামিন এ ও সি রয়েছে । তাছাড়া মুখীকচুর স্টার্চের হজম যোগ বেশী বিধায় এর স্টার্চ শিশু খাদ ̈হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মুখীকচু ক্ষারজাতীয় খাদ্য বিধায় অম্ল শুলেও এটি উপকারী।
মুখীকচু খরিপ মৌসুমে সবজির অভাব পূরণে সাহায্য করে থাকে। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, মুখীকচু বাংলাদেশে পোকা ও রোগবালাই তেমন না থাকায় খরচ কম সে কারণেই কৃষকরা মুখীকচুর চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। কচুগোত্রীয় সবজির মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয় মুখীকচু।তবে আশানুরূপ ফলন পেতে হলে উৎপাদনের জন্য আধুনিক উন্নত প্রযুক্তি অনুসরণ করতে হবে। বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া মুখীকচু চাষের জন্য উপযোগী।
![]() |
| মুখীকচু চাষ এর আধুনিক ও উন্নত পদ্ধতি |
মুখীকচুর জাতঃ
দেশী জাতঃ মুখীকচু বাংলাদেশে গুড়া কচু, কুড়ি কচু, ছড়া কচু, দুলি কচু, বিন্নি কচু, ইত্যাদি নামে ও পরিচিত। তাছাড়া স্থানীয় ভাবে বেশ কিছু দেশী মুখীকচুর জাত চাষ হয়ে থাকে।
উচ্চ ফলনশীল জাতঃ উচ্চ ফলনশীল জাতের মধ্যেই বাংলদেশ কৃষি গবেষণা ইনিস্টিটিউট (বারি)-এর উদ্ভবিত ‘বিলাসী’ নামের নতুন জাতটিই চাষের জন্য মাঠ পর্যায়ে বেশ জনপ্রিয়।কারণ এর মুখীগুলো খুব মসৃণ ও ডিম্বাকৃতির। এটি পাতার মড়ক রোগে সহজে আক্রান্ত হয়না ও পোকামাকড়ের আক্রমণ কম। সিদ্ধ করলে মুখী সমানভাবে সিদ্ধ হয়। এর মুখী নরম ও সুস্বাদু এবং ক্যালসিয়াম আক্সালেটের পরিমান কম থাকায় খাওয়ার পর গলার ভেতরে চুলকায় না।অতিসম্প্রতি বারি মুখীকচু-২ নামে আরও একটি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবিত হয়েছে।
মুখীকচুর উপযোগী জমি ও মাটিঃ
সারাদিন রোদ পায় এমন স্থানে মুখীকচু লাগানো উচিৎ।দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি মুখীকচু চাষের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী। তবে জমিতে প্রচুর পরিমাণ জৈব পদার্থ থাকা উচিত। এ ফসলের জন্য উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু প্রয়োজন। তাছাড়া বসতবাড়ির আঙ্গিনায়, উঁচু ভিটায়, টিলায়ও মুখীকচু চাষা করা যায়।
মুখীকচুর বীজঃ
ভালো বীজ নির্বাচনঃ মুখীর ছড়া রোগ মুক্ত, পুষ্ট হতে হবে।
বীজের হারঃ মুখীর ছড়া বীজ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। রোপণের জন্য মুখীর ছড়া প্রতি শতক জমিতে ২-২.৫ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়।এবং প্রতিটি বীজের ওজন ১৫-২০ গ্রাম হওয়া বাঞ্চনীয়।
জীবনকালঃ মুখীকচুর জীবনকাল ১৮০-২০০ দিন।
মুখীকচুর জমি তৈরীঃ
জমি চাষঃ মাটির জোঁ থাকা অবস্থায় জমিতে ৪-৫ টি লম্বা ও আড়াআড়ি চাষ এবং মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে দিতে হবে।
মুখীকচুর বপন ও রোপন এর পদ্ধতিঃ
বীজ বপনের সময়ঃ
বীজ লাগানোর দূরত্বঃ বীজ লাগানোর দুরত্ব নির্ভর করে মাটির গুনাগুনের উপর। মুখীকচুর সাধারণত৭৫×২৫সেমি দূরত্বে বীজ বপন করতে হয়। যদি মাটির উর্বরতা কম হয় তবে ৬০×২৫সেমি দূরত্বে বীজ বপন করতে হয়।
ছিটিয়ে বা লাইনে বপনঃ সাধারনত লাইনে মুখীকচুর বপন করতে হয়।
মুখীকচু বপনের সময়ঃ মধ্য মাঘ -মধ্য ফাল্গুন ( ফেব্রুয়ারী) মুখীকচুর বীজ বপনের জন্য সবচেয়ে ভাল সময়।
মুখীকচুর রোপন এর পদ্ধতিঃ
রোপন এর সময়ঃ মধ্য-চৈত্র থেকে মধ্য-বৈশাখ (এপ্রিল-মে) মুখীকচুর রোপনের উপযুক্ত সময়।
রোপন এর দূরত্বঃ
একক সারি পদ্ধতিঃ উর্বর মাটির জন্য লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব ২৪ ইঞ্চি এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ১৮ ইঞ্চি। মুখীকচুর অনুর্বর মাটির বেলায় লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব ২৪ ইঞ্চি এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ১ ফুট ৪ ইঞ্চি রাখতে হয়।
ডাবল সারি পদ্ধতিঃ এই পদ্ধতিতে লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব ৩০ ইঞ্চি এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ২৪ ইঞ্চি। আড়াই ফুট দূরে দূরে লম্বালম্বি দাগ টানতে হয়। এই দাগের উভয় পাশে ৪ ইঞ্চি দূর দিয়ে ২৪ ইঞ্চি পর পর বীজ লাগিয়ে যেতে হবে। এতে দুই লাইনের মধ্যে দূরত্ব ২২ ইঞ্চি এবং এক সারির দুই লাইনের মধ্যে দুরত্ব ৮ ইঞ্চি। এই পদ্ধতিতে বীজ লাগালে ফলন প্রায় ৪০-৫০% বেড়ে যায়। দুই সারির ৩ টি বীজ সমদ্বিবাহু ত্রিভুজ উৎপন্ন করবে।
মুখীকচুর সার ব্যবস্থাপনাঃ
সারের নাম ও পরিমাণ
গোবর ৫০ কেজি ( প্রতি শতকে)
ইউরিয়া ৬০০ গ্রাম ( প্রতি শতকে)
টিএসপি ৫০০ গ্রাম ( প্রতি শতকে)
এমপি৷ ৭০০ গ্রাম ( প্রতি শতকে)
প্রয়োগ পদ্ধতিঃ গোবর, টিএসপি এবং এমওপি রোপণের সময় এবং ইউরিয়া ৪০-৪৫ দিন পর প্রয়োগ করতে হয়।
আগাছা দমনঃ
সময়ঃ রোপনের ৪০-৪৫ দিন পর এবং ৯০-১০০ দিন পর মুখীকচুর আগাছা বাছাই করতে হবে।
দমন পদ্ধতিঃ জমিতে নীড়ানি / ছোট কোদাল দিয়ে মুখীকচুর আগাছা দমন করা হয়ে থাকে।
মুখীকচুর জমিতে সেচ ব্যবস্থাঃ
সেচের সময়ঃ মুখীকচুর জমিতে রস না থাকলে সেচের প্রয়োজন হয়। দু’সারির মাঝখানে নালা দিয়ে সেচ দেওয়া সুবিধাজনক।
পানি নিষ্কাশনঃ মুখীকচু সাধারনত দাড়ানো পানি সহ্য করতে পারে না। তাই নালার মাধ্যমে অধিক বৃষ্টি বা সেচের পানিও বের করে দেয়া যেতে পরে।
রোগ ও পোকামাকড়ঃ
মুখীকচু চাষ করলে বিভিন্ন ধরনের রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হয়ে থাকে। এইসব রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হতে রক্ষার ও প্রতিরক্ষার জন্য স্হানীয় কৃষি অফিসে বা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করুন অথবা ekrishi24 এর সাথে থাকুন।
বিশেষ পরিচর্যাঃ
গাছের গোড়ায় মাটিঃ সারিতে মাটি তুলে দেওয়া মুখীকচু ফসলের প্রধান পরিচর্যা। মাটি একবারে না তুলে দুই-তিনবারে তোলা ভালো। ভালো ফলন পাওয়ার জন্যেই নিড়ানী বা ছোট কোদালের সাহায্যে গাছের গোড়ার মাটি কুপিয়ে ঝুরঝুরে করে গোড়ার মাটি উঁচু করতে হবে। মাটি কুপানো, গাছের গোড়ার মাটি দেওয়া ও সারের উপরি প্রয়োগ প্রভৃতি একই সাথে করা যায়। সাবধানতার সাথে এ কাজটি করতে হবে যেন গাছ কোনভাবে আক্রান্ত বা ক্ষত না হয়।
মুখীকচুর ফসল কাটাঃ
সময়ঃ মুখীকচুর গাছ হলদে হয়ে শুকিয়ে গেলে এ কচু তুলতে হবে। রোপণের পর থেকে ৬-৭ মাস সময় লাগে মুখীকচুর তুলতে।
পদ্ধতিঃ লাঙ্গল/কোদাল দিয়ে মাটি আলগা করে মুখীকচুর সংগ্রহ করা হয়ে থাকে।
মুখীকচুর সংরক্ষণ পদ্ধতিঃ
ভালোভাবে সতর্কতার সাথে মুখীকচুর গুড়ি তুলতে হবে। কাটা, পচা, ক্ষতযুক্ত, ছোট-মাঝারি-বড় আকারের মুখীকচু দেখে আলাদা করে রাখতে হবে। ঠান্ডা ও ছায়াময় এবং বাতাস চলাচলের সুবিধাযুক্ত স্হানে স্তুপ করে বা মেঝেতে ছড়িয়ে মুখীকচু শুকাতে হবে। ছায়ায় শুকানোর পর নাড়াচড়া করলে গুড়ির গায়ের মাটিসহ অন্যান্য ময়লা পড়ে গিয়ে গুড়ি পরিষ্কার হয়ে যায়। এরপর ঘরের ছায়াযুক্ত স্হানে মাচা বা কাঠের উপর রেখে শুকনো ঠান্ডা পরিষ্কার বালি দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়। এভাবে মুখীকচু ৪/৭ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
