জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা

জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষি

ekrishi24: জ্যৈষ্ঠ মাসে পাকা ও মিষ্টি ফলের গন্ধে মাতোয়ারা বাংলার প্রান্তর। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, তরমুজ, বাঙ্গিসহ মৌসুমি ফলের ঘ্রাণে  বাংলার মানুষের মনকে  আরো পাগল করে দেয়। এছাড়াও মৌসুমি ফলের প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমেই তৈরি আচার, চাটনি, জ্যাম, জেলি জ্যৈষ্ঠের গরমে ভিন্ন স্বাদের ব্যঞ্জনা নিয়ে হাজির হয়। প্রিয় পাঠক,এই মধুময় জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষি কথা চলুন একপলকে কবিতার মাধ্যমে জেনে নেই।
জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা,মধু মাস জ্যৈষ্ঠ।চারদিকে শুধু পাকা ফলের মিষ্টি গন্ধ। কিছুদিন পরেই হয়তো পাকা ফল গাছ থেকে পেড়ে খাবেন। নিজ বাগানের ফল পেড়ে খাওয়াতে রয়েছে সৌভাগ্যময় অনুভূতি ও অতুলনীয় অভিব্যক্তি।
জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষি

লখকঃমোঃ শরীফ উদ্দিন

জ্যৈষ্ঠ মাসের মধুর ঘ্রাণে 
অগ্নি তাপ যে জাগে প্রাণে
রসাত্মক ঐ ফলে, 
টক-মিষ্টি সেই স্বাদটা নিতে
ঝড়-তুফানে দৌড়াই গীতে
আম্র বাগের তলে।

আম কাঁঠাল আর মিষ্টি লিচু 
জ্যৈষ্ঠে পাই যে অনেক কিছু 
এই না সবুজ তটে, 
কৃষক মাঠে দিবানিশি 
তুফান ভেঙে ফলায় কৃষি 
শান্তি যেনো রটে।

খরা বৃষ্টি দুইয়ে ঋষ্ট
ফলকে করে রসে সৃষ্ট 
ঝড় তাপের এই খরা,
কাটফাটা ঐ রৌদ্র মাঝে 
বৃষ্টি এসে ভাঁজে ভাঁজে 
ভিজিয়ে দেয় ধরা।

পাখপাখালি কাঠবিড়ালি 
জ্যৈষ্ঠে করে গাছটি খালি
পাকা ফলটি খেয়ে, 
রসাত্মক ঐ মিষ্টি ফলে
সবাই চলে শক্তি বলে
মধু মাসটি পেয়ে। 

মাস ভিত্তিক কৃষির আলোচনায় আজকে জানাবো জ্যৈষ্ঠ মাসের চাষাবাদ সম্পর্কে।


জ্যৈষ্ঠ মাসের বোরো ধান

আপনার জমির ধান শতকরা ৮০ ভাগ পেকে গেলে রিপার/কম্বাইন হারভেস্টারের মাধ্যমে কম খরচে, স্বল্প সময়ে ধান সংগ্রহ করে ভালোভাবে শুকিয়ে নিয়ে শুকনো বীজগুলো ছায়ায় ঠান্ডা করে প্লাস্টিকের ড্রাম, বিস্কুটের টিন, মাটির কলসি এসবে সঠিকভাবে সংরক্ষন করতে হবে।

(কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে প্রতি ঘন্টায় প্রায় ৪ বিঘা জমির ধান কাটা ও মাড়াই করা যায়। হাত/রিপার দিয়ে সংগৃহীত ধান পাওয়ার থ্রেসার দিয়ে মাড়াই করুন। এতে সময় ও খরচ বাঁচবে।)



জ্যৈষ্ঠ মাসের আউশ ধান

আউশের বীজ বোনা না হয়ে থাকলে এখনই বীজ বপন করতে হবে। চারার বয়স ১২ থেকে ১৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের প্রথম কিন্তুি হিসেবে একর প্রতি ১৮ কেজি ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করুন। এর ১৫ দিন পর একই মাত্রায় দ্বিতীয় কিন্তুি উপরি প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সারের কার্যকারিতা বাড়াতে জমিতে সার প্রয়োগের সময় ছিপছিপে পানি রাখাসহ জমি আগাছা মুক্ত রাখুন।



জ্যৈষ্ঠ মাসের আমন ধান

জ্যৈষ্ঠ মাসের মধ্যেই রোপা আমনের জন্য বীজতলা তৈরি করুন এবং বন্যাকালীন সময়ে চারা নষ্ট হয় বিধায় অধিক পরিমাণ চারা উৎপাদন করুন। 

• লবণাক্ত এলাকার জন্য ব্রি ধান-৫৩, ব্রি ধান-৫৪, ব্রি ধান-৭৩। 

• অলবণাক্ত জোয়ার ভাটা এলাকার জন্য ব্রি ধান-৭৬,ব্রি ধান-৭৭, ব্রি ধান-৭৮। 

• জলমগ্ন এলাকার জন্য ব্রি ধান-৫১, ব্রি ধান-৫২, ব্রি ধান-৭৯।

• খরা প্রবণ এলাকার জন্য ব্রি ধান-৫৬, ব্রি ধান-৭১।

• স্বল্পমেয়াদি হিসেবে ব্রি ধান-৫৭, ব্রি ধান-৭৫ ব্রি ধান-৮৭, ব্রি ধান-৮০, ব্রি ধান-৪১, ব্রি ধান-৮৩, ব্রি ধান-৪, ব্রি ধান-৮৫।

• জিংক সমৃদ্ধ ধানের জন্য ব্রি ধান-৬২, ব্রি ধান-৭২, বিনা ধান-২০।

• এছাড়া অধিক ফলনের জন্য ব্রি হাইব্রিড ধান-৪, ব্রি হাইব্রিড ধান-৬ আবাদ করা যায়। খরাপ্রবণ এলাকায় রোপা আমন ধানক্ষেতে মিনি পুকুর খনন করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিন।

জ্যৈষ্ঠ মাসে আউশ ও বোনা আমনের জমিতে পামরী পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। আক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে হাতজাল, গামছা, লুঙ্গি, মশারি দিয়ে পামরী পোকা ধরে মেরে ফেলুন। তাছাড়া আক্রান্ত গাছের গোড়া থেকে ৫ সেন্টিমিটার (২ ইঞ্চি) রেখে বাকি অংশ কেটে দিন। আক্রমণ বেশি হলে অনুমোদিত কীটনাশক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করুন।



জ্যৈষ্ঠ মাসের ভুট্টা (খরিফ)

খরিফ ভুট্টার বয়স ২০-২৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের উপরি প্রয়োগ করতে হবে। মাটিতে রসের ঘাটতি থাকলে হালকা সেচ দিতে হবে। জমিতে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং একই সাথে গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে।



জ্যৈষ্ঠ মাসের পাট

পাটের জমিতে আগাছা পরিষ্কার, ঘন ও দুর্বল চারা তুলে পাতলা করা, সেচ এসব কাজগুলো যথাযথভাবে করতে হবে। ফাল্গুনী তোষা জাতের জন্য একরপ্রতি ৪০ কেজি ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। মাটিতে রস না থাকলে বা দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হলে হালকা সেচ দিতে হবে এবং বৃষ্টির করণে পানি জমে থাকলে তা নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। পাটশাক যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টিকর। তাই নিড়ানির সময় তোলা অতিরিক্ত পাটের চারা ফেলে না দিয়ে শাক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এ মাসে পাটের বিছা পোকা এবং ঘোড়া পোকা জমিতে আক্রমণ করে থাকে। বিছা পোকা দলবদ্ধভাবে পাতা ও ডগা খায়, ঘোড়া পোকা গাছের কচি পাতা ও ডগা খেয়ে পাটের অনেক ক্ষতি করে থাকে। বিছা পোকা ও ঘোড়া পোকার আক্রমণ রোধ করতে পোকার ডিমের গাদা, পাতার নিচ থেকে পোকা সংগ্রহ করে মেরে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। জমিতে ডালপালা পুঁতে দিলে পোকা খাদক পাখি যেমন শালিক, ফিঙ্গে এসব পোকা খেয়ে আমাদের দারুণ উপকার করে। আক্রমণ বেশি হলে অনুমোদিত কীটনাশক সঠিকভাবে, সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।



জ্যৈষ্ঠ মাসের শাক-সবজি 

লতানো সবজির দৈহিক বৃদ্ধি যত বেশি হবে তার ফুল ফল ধারণ ক্ষমতা তত কমে যায়। সেজন্য বেশি বৃদ্ধি সমৃদ্ধ লতার ১৫-২০ শতাংশের কেটে দিন এতে তাড়াতাড়ি ফুল ও ফল ধরবে। কুমড়া জাতীয় সব সবজিতে হাত পরাগায়ন বা কৃত্রিম পরাগায়ন অধিক ফলনে দারুণভাবে সহায়তা করবে। গাছে ফুল ধরা শুরু হলে প্রতিদিন হাত পরাগায়ন নিশ্চিত করলে ফলন অনেক বেড়ে যাবে।

জ্যৈষ্ঠ মাসে কুমড়া জাতীয় ফসলে মাছি পোকা দারুণভাবে ক্ষতি করে থাকে। এক্ষেত্রে জমিতে খুঁটি বসিয়ে খুঁটির মাথায় বিষটোপ ফাঁদ দিলে বেশ উপকার হয়। এ ছাড়া সেক্স ফেরোমন ব্যবহার করেও এ পোকার আক্রমণ রোধ করা যায়।


জ্যৈষ্ঠ মাসের গাছপালা

আগামী মাসে চারা লাগানোর জন্য জায়গা নির্বাচন, গর্ত তৈরি ও গর্ত প্রস্তুতি, সারের প্রাথমিক প্রয়োগ, চারা নির্বাচন এ কাজগুলো জ্যৈষ্ঠ মাসেই শেষ করতে হবে। নারিকেল, সুপারির উপযুক্ত মাতৃগাছ থেকে ভালোবীজ সংগ্রহ করে বীজতলায় এখন লাগাতে পারেন।



জ্যৈষ্ঠ মাসের অন্যান্য

বাড়ির কাছাকাছি উঁচু এমনকি আধা ছায়াযুক্ত জায়গায় আদা হলুদের চাষ করুন। বসতবাড়ির আশেপাশে মাত্র ৫ মি. ও ২মি. (১০ হাত ও ৪ হাত) পরিমাণ জায়গা থাকলে জ্যৈষ্ঠ মাসে বরি পেঁয়াজ-৫ এর চারা রোপণ করে ১৫-২০ কেজি ফলন পাওয়া যায়। মাঠের মিষ্টি আলু, চিনাবাদাম বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই তুলে ফেলুন। গ্রীষ্মকালীন মুগডালের চাষও এ মাসে করতে পারেন। পতিত বা আধা ছায়াযুক্ত স্থানে অনায়াসে লতিরাজ বা পানি কচু বা অন্যান্য উপযোগী কচুর চাষ করুন। সবুজ সার করার জন্য ধইঞ্চা বা অন্য গাছের বয়স ৩৫-৪৫ দিন হলে চাষ ও মই দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিন। সবুজ সার মাটিতে মেশানোর ৭/১০ দিন পরই ধান বা অন্যান্য চারা রোপণ করতে পারবেন।




জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রাণিসম্পদ :

জ্যৈষ্ঠ মাসে প্রাণিচিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে হাঁস মুরগির ভ্যাকসিন দিতে হবে। এছাড়া হাঁস মুরগির কৃমির জন্য ওষুধ খাওয়ানো, ককসিডিয়া রোগ হলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহাণ এবং জরুরিভাবে অন্যান্য প্রতিষেধক টিকা দিয়ে দিতে হবে। মুরগি ও হাঁসের বাচ্চা ফোটানোর কাজটি ভরা বর্ষার আগেই সেরে ফেলতে হবে। বর্ষার নিয়মিত এবং পরিমিত গো-খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করাসহ অন্যান্য কাজগুলো সঠিকভাবে করতে হবে। গবাদি পশুর গলাফোলা, ডায়রিয়া, ক্ষুরারোগ, নিউমোনিয়াসহ অন্যান্য রোগের ব্যাপারে টিকা দেয়াসহ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিতে হবে।


জ্যৈষ্ঠ মাসের মৎস্যসম্পদ :

মাছ প্রজননে আগ্রহী চাষিভাইদের স্ত্রী-পুরুষ মাছ (ব্রুড ফিশ), পিটুইটারি গ্রন্থি, হাপা এবং ইনজেকশনের সরঞ্জামাদি জ্যৈষ্ঠ মাসেই প্রস্তুত রাখতে হবে। আঁতুড় পুকুর বন্যায় ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলে পাড় উঁচু করে বেঁধে দিতে হবে। আঁতুড় পুকুরে পোনার আকার ১ ইঞ্চি হলে সাবধানে ধরে চারা পুকুরে ছাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নিয়মিত তদারকি, রাক্ষুসে মাছ তোলা, আগাছা বা জংলা পরিষ্কার, খাবার দেয়া, সার দেয়া, সম্পূরক খাবার দেয়া, জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা এসব প্রাসঙ্গিক কাজগুলো নিয়মিত করতে হবে। এছাড়া যে কোনো সমস্যায় উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।


যোগাযোগঃ

কৃষি বিষয়ক যে কোন সমস্যার সমাধান ও ফসলের রােগবালাই এবং পােকামাকড় দমনে সঠিক পরামর্শ দিতে আপনার পাশে রয়েছে ekrishi24.com অথবা নিকটস্থ “কৃষক তথ্য ও পরামর্শ কেন্দ্র (ফিয়াক)” অথবা “উপ সহকারী কৃষি অফিসার” এর সাথে যোগাযোগ করুন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url