ধানের গান্ধী পোকা / Rice Bug | ধানের পোকা

ধানের গান্ধী পোকা/(Rice Bug) এর পরিচিতি ও দমন ব্যবস্হাপনা


গন্ধী পোকা শুধু ধান নয় প্রায় ৮০টি ফসলের ক্ষতিকর পোকা নামে পরিচিত। গান্ধি পোকার প্রজাতি সংখ্যা কয়েকশ। অনেক সময় এ পোকা বাড়িতেও চলে আসে। এই পোকা গায়ে পড়লে যে বিকট একধরনের গন্ধ ছাড়ে তা আপনাদের নিশ্চই জানা আছে । কিন্তু কেন এই গন্ধ ছাড়ে তা অবশ্যই জানব তবে তার আগে এই পোকাটির সম্বন্ধে কিছু জেনে নিই । আশা করি ভাল লাগবে।

ধানের গান্ধি পোকা (Rice Bug) এ পোকা সরু লম্বা পা ও শুড় বিশিষ্ট। বাচ্চা সমূহ সবুজ থেকে বাদামী এবং পূর্ণবয়স্ক পোকা বাদামী থেকে হলদে সবুজ বর্ণের হয়।
ধানের গান্ধী পোকা / Rice Bug | ধানের পোকা



গান্ধী পোকার পরিচিত


গান্ধী পোকার নামঃ

বাংলা নামঃ ধানের গান্ধি পোকা।এছাড়াও আরো অনেক নাম আছে।যেমনঃদুর্গন্ধ পোকা,পেদো পোকা ইত্যাদি।
ইংরেজি নামঃ Rice Bug(রাইস বাগ)।
বৈজ্ঞানিক নাম: Leptocorisa oratoria/Leptocorisa acuta.

ধানের ক্ষতিকর রোগ সম্পর্কে আরও জানতে নিছে ক্লিক করুন




গান্ধী পোকার দৈহিক গঠনঃ

লম্বা,ডিম্বাকৃতির,বেলনাকার  ইত্যাদি  নানা আকারের ও নানা  রঙের গন্ধপোকা দেখা যায়।এরা ১মিলিমিটার  থেকে ১০০মিলিমিটার  পর্যন্ত  এদের দৈহিক আকার হয়ে থাকে। অধিকাংশ প্রজাতির দেহ শক্ত বর্মের মত আবরণে আবৃত থাকে।এদের আকৃতি লম্বা অথবা আয়তকার। স্বচ্ছ ডানা এবং মুখে মশা-মাছির মতো শুঙ্গ থাকে। শীতকালে বা অতি ঠান্ডাতে এরা হাইবারনেট বা শীত ঘুমে কাটায়।
তখন স্ত্রী পতঙ্গেরা ১০০থেকে ১৫০টি ডিম পাড়ে।



গান্ধী পোকার বৈশিষ্টঃ

এ পোকা সরু লম্বা পা ও শুড় বিশিষ্ট। বাচ্চা সমূহ সবুজ থেকে বাদামী এবং পূর্ণবয়স্ক পোকা বাদামী থেকে হলদে সবুজ বর্ণের হয়।


ধানের ক্ষতিকর পোকা সম্পর্কে আরও জানতে নিছে ক্লিক করুন




গান্ধী পোকার জীবনকালঃ এ পোকার জীবনকাল ৬০-৯০ দিনের হয়।



গান্ধী পোকার জীবনচক্রঃ

 জীবনচক্রের স্তর ৪ টি- ডিম ৩-৬ দিন, নিম্ফ ১৫-৩০ দিন, পূর্ণবয়স্ক ৩০-৫০ দিন এবং বছরে ৫ টি জেনারেশন দিতে পারে। এবং স্ত্রী পোকা ধানের পাতা ও শীষের উপর ২৪-৩০ টি গোলাকার খয়েরী রঙ এর ডিম সারি করে পাড়ে।

ধানের চাষাবাদ সম্পর্কে আরও জানতে নিছে ক্লিক করুন 

গান্ধি পোকার ক্ষতির ধরণঃ

নিস্ফ বা বাচ্চা ও পূর্ণবয়স্ক উভয়ই অবস্থায় ধানের ক্ষতি করে। ধানের ফুল আসার সময় ও দুধ অবস্থায় বাড়ন্ত দানা থেকে রস চুষে নেয়, ফলে ধানে চিটা হয়। 
এবং শক্ত দানা অবস্থায় আক্রমণ করার ফলে আক্রান্ত স্থান কালো হয়ে যায় এবং চাউলের মান খারাপ হয় ও মাড়াইয়ের সময় চাল ভেঙ্গে যায়।



ক্ষতির ব্যপ্তিঃ

ধানের গান্ধী পোকা সময়মত দমন করা না গেলে, মারাত্মক ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে ফসলের জন্য এবং অনেক সময় ৩০% পর্যন্ত ফলন কমিয়ে দেয়।
তবে এরা শুধু ধান নয় প্রায় ৮০টি ফসলের ক্ষতিকরে। এবং এ পোকার কয়েকশ প্রজাতি রয়েছে।

 

গান্ধি পোকার আক্রমনের অনুকূল পরিবেশঃ

দুধ অবস্থা, উচ্চ তাপমাত্রা (২৫-৩০ ডিগ্রি সেঃ), উচ্চ আর্দ্রতা (৮০% উপরে), গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি।




গান্ধি পোকার আত্মরক্ষার কৌশলঃ

গান্ধি পোকা আক্রান্ত  হলে  বদগন্ধ ছড়িয়ে আক্রমনকারীকে দূরে রাখতে চেষ্টা করে।এবং এই বদগন্ধ ছড়ায় মূলত নিজেদের আত্মরক্ষার তাগিদে।
এদের অনেকেই আশেপাশের সবুজ বা শুকনো পাতার সাথে নিজেদের রঙ মিলিয়ে ক্যামোফ্লেজিং করে আত্মরক্ষা  করে।



গান্ধি পোকার গন্ধ ছড়ানোর কারণ / রহস্যঃ

গান্ধী পোকার বক্ষ অঞ্চলের তলদেশে একটি বিশেষ গ্রন্থি আছে এই গ্রন্থিই হলো গান্ধি পোকার গন্ধের জন্য দায়ী। পোকাটি তার এই বিশেষ  গ্রন্থিটিতে গন্ধযুক্ত তরল পদার্থ ট্রান্সডেসিনল এবং ট্রান্স অক্টানল জাতীয় ঘন জৈব রাসায়নিক  পদার্থ  সঞ্চিত  রাখে। এই গ্রন্থির সাথে কতগুলো নল যুক্ত থাকে।

নলগুলো আবার সামনের একজোড়া পায়ে প্রবেশ করে এবং ছিদ্রের মাধ্যমে মুক্ত হয়। ছিদ্রটি পোকা ইচ্ছামত খুলতে এবং বন্ধ করতে পারে।

গান্ধী পোকা রাগান্বিত হলে বা ভয় পেলে গন্ধ গ্রন্থি থেকে দুর্গন্ধযুক্ত রস নল দিয়ে পায়ে চলে আসে এবং বহিঃপরিবেশে উন্মুক্ত হয়।বাতাসে ব্যাপন বা  diffusion  প্রক্রিয়ায় গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে এবং আমাদের নাকে পৌছায়।এটাই গান্ধি পোকার গন্ধ রহস্য।

গান্ধি পোকার গন্ধ এক ধরণের পতঙ্গ  হরমোন বা  "ফেরোমেন" ।  তবে  পৃথিবীর সব প্রজাতির গন্ধ পোকার গায়ের গন্ধ এক নয়। বিভিন্ন প্রজাতির গন্ধপোকাকে শুধু গন্ধ শুঁকেই আলাদা করা যায়।


গান্ধী পোকার কামড়ে করনীয়

আমাদের গায়ের চামড়াতে কোনোভাবে  এই তরল রাসায়নিক  লাগলে জায়গাটা হলুদ হয়ে যায় আর  সাবান দিয়ে না ধোয়া পর্যন্ত তা দূর হয় না।গান্ধি পোকা শরীরে পরলে মানুষের তেমন কোন ক্ষতি হয় না।তবে যাদের পোকা মাকড়ে এলার্জি আছে তাদের ত্বকে ফুসকুড়ি উঠতে পারে অথবা প্রচুর চুলকাতে পারে

তাই গান্ধি পোকা দেখলে তাকে না ঘাটানোই ভাল। কে জানে, কখন সে বিপদ মনে করে গ্যাস ছেড়ে দেয়।



গান্ধি পোকার প্রতিরােধমূলক ব্যবস্থাঃ


>> যদি সম্ভব হয়, পােকার বংশবৃদ্ধির অনুকূল
সময়কে এড়াতে দেরীতে পাকে এমন ধানের
জাত রােপণ করুন।

>> সব জমিতে ধানের চারার একইসঙ্গে রােপণ,
গান্ধী পােকার আক্রমণ কমাতে সাহায্য করে।

>> ফুল আসার প্রথম দিকেই দৈনিক ফসলের মাঠ
নিরীক্ষা শুরু করুন।

>> অন্যান্য আশ্রয় প্রদানকারী উদ্ভিদ যেমন কাঁকড়া
ঘাস, চেচড়া, ও শিম ঘাস উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। 

>> চাষের জমি ও এর আশপাশ থেকে আগাছা অপসারন করতে হবে।

>> গান্ধী পােকাকে আকর্ষণ করতে জমির চারিপাশ
ঘিরে ফাঁদ ফসলের চাষ করতে হবে।

>> সুষম সার প্রয়ােগের পরিকল্পনা করুন।

>> নিয়মিত জল বা পানি সেচ ব্যবস্হা করে,অতিরিক্ত আর্দ্রতা যাতে সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

>> ভােরবেলা বা সন্ধ্যার মুখে জাল ব্যবহার করে গান্ধী পােকা ধরুন।

>> মাঠ ভাসিয়ে পােকাকে ডুবিয়ে মারুন বা পােকাকে গাছের মাথায় যেতে বাধ্য করুন যেখানে সহজেই এদের উপরে কীটনাশক প্রয়ােগ করা সম্ভব।

>> যথাসম্ভব কম কীটনাশক স্প্রে করে উপকারী
কীটগুলাে সংরক্ষণ করুন (যেমন, বােলতা ,
ঘাস ফড়িং এবং মাকড়শা)।



গান্ধি পোকা দমনে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনাঃ

🍎 সমকালীন চাষাবাদ ।

🍎 এ পােকার সংখ্যা যখন খুব বেড়ে যায় তখন ক্ষেত থেকে ২০০-৩০০ মিটার দূরে আলােক ফাঁদ বসিয়ে আকৃষ্ট করে মেরে ফেললে এদের সংখ্যা অনেক কমে যায়।

🍎 বুটিং স্তরের পূর্বে হাতজাল দিয়ে পােকা
ধ্বংস করা।

🍎ক্ষেতের এক পাশে গাড়ীর টায়ার জ্বালিয়ে ধোঁয়ার সৃষ্টি করা।

🍎ডিমের গাঁদা সংগ্রহ করে মারা। 

🍎ইদুর,সাপ বা শামুকের মাংসের সাথে বালাইনাশক মিশিয়ে কাপড়ের পুটলিতে বেঁধে ধানের দুধ আসার সময় বিষ ফাঁদ হিসাবে ব্যবহার করুন।

🍎 পােকা ধ্বংসকারী কিছু কিছু উপকারী পোকা 
বােলতা, ঘাস ফড়িং এবং মাকড়সা, গান্ধী পােকা ও তার ডিমকে আক্রমণ করে।

🍎প্রতি গোছায় ২-৩ টি গান্ধী পোকা দেখা দিলে অনুমোদিত কীটনাশক ব্যবহার করা।

🍎কীটনাশক বিকাল বেলায় প্রয়ােগ করা।



গান্ধি পোকার ভেষজ পদ্ধতিতে দমনঃ


🌶️🌶️ নিম পাতা দ্বারা দমনঃ

দুই কেজি নিম পাতা ১.৫ কেজি নিমের ছাল শিল পাটায় একটু থেঁতলে নিয়ে, এর সাথে ৫০ গ্রাম ডিটারজেন্ট পাউডার মিশায়ে, তাতে ৫ লিটার পানি মিশ্রণ করে,চুলায় জ্বাল দিয়ে ৫ লিটার পানিকে শুকায়ে ১ লিটার পানিতে রূপান্তর করে। উক্ত ১ লিটার পানি ঘেঁকে নিয়ে তার সাথে ১ লিটার পানি যােগ করে স্প্রে করা।


☔☔পাট বীজ দ্বারা দমনঃ

এক কেজি পাট বীজ আস্তে আস্তে কড়াইতে ভেজে নিয়ে ভাজা বীজ পিষে ৬০ লিটার পানিতে ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে। এইবার ঘেঁকে ১ বিঘা জমিতে স্প্রে করা। সাবধানতাঃ কড়াইয়ে ভাজার সময় নাকে রুমাল বা মাক্স ব্যবহার করুন।

রাসায়নিক পদ্ধতিতে দমনঃ


বালাইনাশকের নাম গ্রুপের নাম প্রয়ােগ মাত্রা কোম্পানীর নাম
ক্লোরােসিড ক্লোরােপাইরিফস ১৩৩ মিঃলিঃ/বিঘা করবেল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড
কনভয় ২৫ইসি কুইনালফস ২০০মিঃলিঃ/বিঘা স্কয়ার ফার্মাসিউটিকেস লিঃ
কুইনালগ্রিন ২৫ ইসি কুইনালফস ১৩৩ মিঃলিঃ/বিঘা গ্রিন কেয়ার বাংলাদেশ
কিউর ২৫ইসি কুইনালফস ১৩৩ মিঃলিঃ/বিঘা করবেল কেমিক্যাল ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিঃ
ফাইফানন ৫৭ইসি ম্যালাথিয়ন ১৫০মিঃলিঃ/বিঘা সেতু এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ
হিলথিয়ন ৫৭ ইসি ম্যালাথিয়ন ১৩৩মিঃলিঃ/বিঘা দি লিমিট এগ্রোপ্রােডাক্টস লিঃ
পারফেকথিয়ন ৪০ইসি ডাইমেথােয়েট ১৫০মিঃলিঃ/বিঘা বিএএসএফ বাংলাদেশ লিঃ
ডাইমেজিল ৪০ ইসি ডাইমেথােয়েট ১৩৩মিঃ লিঃ/বিঘা স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিঃ
সেভিন ৮৫ এসপি কার্বারিল ১.৭০ কেজি/হেঃ বেয়ার ক্রপসায়েন্স লিমিটেড
ডারসবান ২০ ইসি ক্লোরোপাইরিফস ১.০০ লিঃ/হেঃ অটো ক্রপ কেয়ার লিমিটেড
ফেনিটক্স ৫০ ইসি ফেনিট্রথিয়ন ১.০০ লিঃ/হেঃ দি লিমিট এগ্রোপ্রোডাক্টস লিমিটেড
ফলিথিয়ন ৫০ ইসি ফেনিট্রথিয়ন ১.০০ লিঃ/হেঃ হেকেম (বাংলাদেশ) লিমিটেড
রগর ৪০ এল ডাইমেথোয়েট ১.১২ লিঃ/হেঃ এসিআই ফর্মুলেশনস লিমিটেড
মিপসিন ৭৫ ডব্লিউপি আইসোপ্রোকার্ব (এমআইপিসি) ১.১২ কেজি/হেঃ পদ্মা ওয়েল কোম্পানী লিমিটেড


যোগাযোগঃ

কৃষি বিষয়ক যে কোন সমস্যার সমাধান ও ফসলের রােগবালাই এবং পােকামাকড় দমনে সঠিক পরামর্শ দিতে আপনার পাশে রয়েছে ekrishi24.অথবা নিকটস্থ “কৃষক তথ্য ও পরামর্শ কেন্দ্র (ফিয়াক)” অথবা “উপ সহকারী কৃষি অফিসার” এর সাথে যোগাযোগ করুন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url